
সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে
ঢাকা, ১০ জুলাই, (ডেইলি টাইমস ২৪): বিদেশি ও সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে বাংলাদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন ১৭ বিদেশিসহ ২০ জিম্মি। সন্ত্রাসী হামলার এ ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স।
সম্প্রতি প্রকাশিত মুডি’সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়াবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের প্রবৃদ্ধিতে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ঋণমানেও এর ছাপ পড়তে পারে।
এর কারণ হিসেবে মুডি’স বলছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে পারে। আর ঋণমান নিরূপণের একটি অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে।
গুলশানের মতো সহিংস ঘটনা আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়ার সংকেত দিচ্ছে। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হলে, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য থেকে সরকারের মনোযোগ সরে যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘ হলে আস্থা হারাবেন বিনিয়োগকারীরা। এতে দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হবে।
সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের সক্ষমতায় সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে মুডি’স।
বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) রপ্তানি খাতের অবদান ১৬.৩ শতাংশ। আর এ রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে প্রবৃদ্ধির জন্য খাতটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুডি’সের বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছে অসাধারণ স্থিতিশীল গতিতে। গত এক দশকে দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে বার্ষিক গড়ে ৬.২ শতাংশ হারে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সাময়িকভাবে কারখানা বন্ধের মতো ঘটনার পরও এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্বল্প সংখ্যক দেশের অন্যতম, যারা বৈশ্বিক চাহিদা মন্দা সত্ত্বেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির এ গতি ধরে রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশের মতো ভিয়েতনামও স্বল্প মূল্যের পোশাক তৈরি বাড়াচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.২ শতাংশ। মূলত ওষুধ, কাঁচা পাট, নিটওয়্যার এবং ওভেন গার্মেন্ট ও হালকা প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিশৃঙ্খলা বহু বছর ধরেই চলে আসছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সম্পর্কের মেরুকরণও গভীরভাবে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধারাবাহিক ও ধ্বংসাত্মক ধর্মঘট এবং মিছিলের মাধ্যমে। এ ধরনের কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পায় নির্বাচন সামনে রেখে।
তবে ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী, রাজনৈতিক এসব কর্মকাণ্ড অতীতে কখনই বিদেশি বিনিয়োগ কিংবা রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
গ্লোবাল টেররিজম ডাটাবেজের সূত্র উল্লেখ করে মুডি’সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৬৫। ২০১২ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটে মাত্র ১৮টি। মুডি’সেরই অন্য এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোনো দেশের অর্থনীতির ওপর সহিংস হামলার এমন ঘটনা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে বিনিয়োগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হতে পারে। তবে বৈশ্বিকভাবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ আগেও এমন সংকটের সময় কাটিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এটির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে না। এর দুটো কারণ— এক. বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা ও অর্থনীতির গতিশীলতা এবং দুই. এ দেশের বর্তমান নেতৃত্বের সক্ষমতা।
মুডি’সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের বন্ড রেটিং ‘বিএথ্রি’। দেশের স্থিতিশীল ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি তুলনামূলক স্বল্প ঋণের বোঝা এ রেটিংয়ে ভূমিকা রেখেছে। আর স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহ ও স্থানীয় ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম। তবে জনপ্রতি নিম্ন আয়, নিয়মিত বাজেট ঘাটতি ও দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলাদেশে ঋণমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।