ফিচার

এরদোয়ানের ‘পাল্টা ক্যু’র টার্গেট কারা?

ঢাকা, ২১ জুলাই, (ডেইলি টাইমস ২৪):

ইউরোপ এবং এশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ তুরস্কে কিছুদিন আগেই এক ব্যর্থ ক্যু সংঘঠিত হয়। রাজধানী ইস্তামবুলে সেনাবাহিনীর একাংশ রাতের আধারে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে সরকারি বেশকিছু স্থাপনা দখল করে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের রাজনৈতিক বিচক্ষনতায় ক্যু ব্যর্থ হয় এবং প্রেসিডেন্টের সমর্থনে একে পার্টির সমর্থকরা ইস্তামবুলের রাস্তায় জড়ো হয়। রাতের আধার শেষ হয়ে ভোর হলে এরদোয়ান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে জানান যে, ক্যু ব্যর্থ হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রাধীন সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানকারী সেনাবাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভ্যুত্থানকারীদের কিছু সময়ের মধ্যেই গ্রেপ্তার করলেও, পরের দিন থেকেই শুরু হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যু সমর্থনকারী বিপুল মানুষকে গ্রেপ্তার। এরদোয়ানের এই চটজলদি অ্যাকশন এবং গ্রেপ্তারকৃতদের তালিকা দেখে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলছে যে, ব্যর্থ ক্যু’টি ছিল একটি সাজানো নাটক। এই ক্যু’কে ব্যবহার করে এরদোয়ান আরও একনায়ক হয়ে উঠতে পারে।

ক্যু ব্যর্থ হওয়া মাত্রই এরদোয়ানের নির্দেশে অভিযান শুরু হয়। প্রথমেই নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে এই অভিযান চালানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীতে অভিযান শেষ করতে না করতেই এই প্রথমবারের মতো তুরস্কের ইতিহাসে বেসামরিক অবকাঠামোকেও আঘাত করা হয়। এক তুর্কিশ কলামিস্ট এরদোয়ানের এই অভিযানকে ‘পাল্টা ক্যু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সম্প্রতি। বেসরকারি অবকাঠামোর বিভিন্ন বিভাগ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরমধ্যে বাদ যায়নি বিচারপতি থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষক পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, কোনো অধ্যাপক বা শিক্ষক যেন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত দেশত্যাগ না করে সেই নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।

অবস্থাটা এমন যে, এরদোয়ান তার ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রের প্রায় সবগুলো বিভাগকেই তার লক্ষ্যে পরিনত করেছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে এরদোয়ান যুক্তি দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বসে ফেতুল্লা গুলেনের মতাদর্শে বিশ্বাসীরাই তুরস্কের অভ্যন্তরে একটি ‘প্যারালাল স্টেট’ চিন্তা করেছিল এবং এই চিন্তা থেকেই ব্যর্থ ক্যু’র সৃষ্টি। কেউই জানে না আসলে কি ঘটছে তুরস্কে। তবে এটা কিন্তু সত্যি যে, এরদোয়ানের কাছাকাছি থাকা কিছু পদাভিষিক্ত মানুষ ছিলেন গুলেনের সমর্থক। এদের মধ্যে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধানের সহকারী আলী ইয়াজকি এবং বিমান বাহিনীর উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এরকান কিভরাক। এরদোয়ান এই ব্যর্থ ক্যু’র জন্য গুলেনকে এমনটাই দোষারোপ করছেন যে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গুলেনের সমর্থকরা তাকে হত্যার চেষ্টাও করেছিল। যদিও এই বক্তব্যের সত্যতা কোনো মিডিয়ার কাছেই নেই।

ঠিক কে বা কারা এরদোয়ানের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন তা এখনও সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তুরস্কের আভ্যন্তরীন রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, এরদোয়ান এখনও পুরো তালিকা তৈরি করেনি, তবে গ্রেপ্তারকৃতদের তালিকা দেখে মনে হচ্ছে, গুলেনপন্থীদের একজনকেও এরদোয়ান মুক্ত বাতাসে ঘুরতে দেবেন না। ইতোমধ্যেই ৯ হাজার বেসামরিককে গ্রেপ্তার এবং বহু সংখ্যাক মানুষকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত সঠিক হিসেবটি বলা মুশকিল। এরমধ্যেও যে তালিকা পাওয়া গেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত, তা দেয়া হলো।

  • সাড়ে সাত হাজার সৈন্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১৮জন জেনারেল ও অ্যাডমিরাল।
  • ৮ হাজার পুলিশকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং ১ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
  • বিচার বিভাগের ৩ হাজার সদস্য, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৮১ জনই বিচারক। এদের সকলকেই বরখাস্ত করা হয়েছে।
  • শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৫ হাজার ২০০ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
  • ২১ হাজার বেসরকারি শিক্ষকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে।
  • অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১৫০০ জনের চাকরি বাতিল।
  • ৪৯২জন ইমাম এবং ধর্মীয় শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে।
  • সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের ৩৯৩জনকে পুরোপুরি বরখাস্ত।
  • প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ২৫৭জনকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
  • গোয়েন্দা বিভাগের ১০০জনকে বরখাস্ত।

শিক্ষার উপর আঘাত কেন?
তুরস্কের স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামিক শিক্ষা প্রচলন করা এরদোয়ানের একটি ব্যক্তিগত মিশন। ২০০২ সালে তার পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘ইমাম হাতিপ’ স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে নব্বই শতাংশ। বারবার বিভিন্ন সময় বক্তব্যে এরদোয়ান বলেছেন যে, তিনি একটি ধার্মিক প্রজন্ম চান, আর তাই তিনি শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনার পক্ষে। গুলেনের প্রতি এরদোয়ানের ক্ষোভ এতটাই প্রচণ্ড যে, তুরস্কের বাইরেও গুলেনের মতাদর্শে বিশ্বাসী স্কুলগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করছেন এরদোয়ান। রুমানিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তুরস্কের কর্মকর্তারা রুমানিয়ায় পরিচালিত ১১টি স্কুল বন্ধ করে দেয়ার জন্য বলেছেন, কারণ হিসেবে বলা হয় ওই স্কুলগুলো গুলেনের মতাদর্শে চালিত হয়।

সরকারি চাকরিজীবিদের বরখাস্ত করার কারণ?
সরকারি চাকরিজীবিদের উপর যে এই প্রথমবার চড়াও হয়েছেন এরদোয়ান তা নয়। এর আগেও ২০১০ সালে সরকারি চাকরি পেতে যে পরীক্ষা দিতে হয় সেখানে ৩ হাজার ২২৭জনকে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল, তারা ভালো নম্বর পেলেও। গুলেনপন্থী বলে তাদের চাকরিতে নেয়া হয়নি বলেও তখিন অভিযোগ উঠেছিল। তবে এরদোয়ান যে শুধুই গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এমনটা করেছেন বা করছেন তা নয়, দেশটির শক্তিশালী সম্প্রদায় আলভীদের ধ্বংস করার চেষ্টাও তিনি করেছেন। তুর্কি একে পার্টি মূলত সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও আলভী সম্প্রদায়ের কিছু সমর্থন তাদের প্রতিও ছিল। কিন্তু সম্প্রদায় হিসেবে আলভীতে শিয়া এবং মুসলিমদের মধ্যকার অন্যান্য শাখার প্রভাবই সর্বাধিক।

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button