
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর যেমন আছে তুরস্ক
ঢাকা, ২৩ জুলাই, (ডেইলি টাইমস ২৪):
রক্তক্ষয়ী ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। এরই মধ্যে তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
গত ১৫ জুলাই থেকে অভ্যুত্থান পরবর্তী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেশটিতে ৫০ হাজার পুলিশ, সেনা ও নৌ কর্মকর্তা, শিক্ষক, বিচারক এবং সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আটক করা হয়েছে ৯ হাজার সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে। এখনও ধড়পাকড় অব্যাহত রয়েছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে তুলে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের বিধান ফেরানোর।
এ অবস্থায় তুর্কিরা তাদের দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছে? ইস্তাম্বুলের মা, বাবা, শ্রমিক, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন তাদের অনুভূতির কথা;
ইলমাজ, ট্যাক্সিচালক
৫১ বছর বয়সী ইলমাজ ইস্তাম্বুল নিবাসী। ছয় সন্তানের জনক ও ট্যাক্সিচালক। তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা মানে সেনাশাসন, তাহলে ক্যু’র সঙ্গে এর তফাৎ কোথায়?
ব্যর্থ সেনাঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ইলমাজের ভাষ্য, আমি জানি না অভ্যুত্থান চেষ্টার পেছনে কে আছে? এ ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন, আপনি মনে করতেই পারেন যে এর পেছনে ফেতুল্লাহ গুলেন জড়িত।কিন্তু হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
রিদভান, বাবুর্চি
২৭ বছর বয়সী রিদভান বলেন, যারা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে, তারা ভুল করেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তুরস্ক তাদের বিচারের মুখোমুখি করবে। জরুরি অবস্থা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। এই অভ্যুত্থান চেষ্টা সম্পূর্ণভাবে তুরস্কের বিরোধী পদক্ষেপ ছিল। এতে জড়িত প্রত্যেককে আমরা তাদের কৃতকর্মের মূল্য দিতে বাধ্য করব। এই অভ্যুত্থান আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারেনি।
আলী, শিক্ষক
৭০ বছর বয়সী এই শিক্ষক আলী বলেন, জরুরি অবস্থার কারণে জনগণের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার আশংকায় আমি চিন্তিত। আমি ব্যথিত যে, সমাজে বিধিনিষেধ চেপে বসেছে। তবে আমি মনে করি না সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করবে।
তিনি আরও বলেন, আমি এখন পর্যন্ত জানি না যে অভ্যুত্থান চেষ্টার নেপথ্যে কে আছে? আমি প্রমাণ দেখতে চাই। অবশ্যই এ অভ্যুত্থান চেষ্টার কারণে আমি মানসিকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এটি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার উপায় নয়। আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট এরদোগান দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামলেছেন। তার প্রাণনাশের চেষ্টা হলেও তিনি নিজেকে হেফাজত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সফলভাবে পরিস্থিতি মোকাবলা করেছেন।
তবে আলী জানান, তিনি দেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। যারাই এই অভ্যুত্থান চেষ্টার নেপথ্যে থাকুক না কেন তিনি তাদের শাস্তি চান। সেটি যদি মৃত্যুদণ্ড বুঝায় তাতেও তার কোনো আপত্তি নেই বলে জানান।
এরদেম, বেসরকারি খাতের শ্রমিক
৩৮ বছর বয়সী এরদেম বলেন, আমার মনে হয় অভ্যুত্থার চেষ্টার সঙ্গে বিদেশী শক্তি জড়িত। ফেতুল্লাহ গুলেনের মাধ্যমে তারা তুরস্কে আক্রমণের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের সামনে বেশ উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে। সবার অলক্ষ্যেই তুরস্ক এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পরোয়া করার প্রয়োজন নেই তুরস্কের। আমরা নিজেদের শক্তিতেই অনেক বেশি শক্তিশালী।
তলগা, পেশাদার অভিনেতা
৩৭ বছর বয়সী তলগা বলেন, আমি খুবই ভয় পাচ্ছি। অভ্যুত্থান চেষ্টা হল ক্ষমতাসীনদের নাটক। আমি আমার দেশের প্রতি সমবেদনা জানাই। আমরা এরই মধ্যে ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি, যা এখন জঘন্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ বছর আমার অভিনয় জীবনের ২০ বছর পার করছি। যখন আমি অভিনয় শুরু করি, তখন আমরা খুশিমতো রাস্তায় যেতে পারতাম। এখন প্রতিনিয়তই তল্লাশি ও হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। আমরা এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে হাসাতে চাই, কিন্তু সরকার আমাদের বাধা দিচ্ছে। যদি সবাই ঘৃণার পরিবর্তে ফুল বিনিময়ে করে তাহলেই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।
ডামলা, তরুণী মা
হাইস্কুল পড়াকালীন ড্রপআউট হয়ে যাওয়া বেকার তরুণী মা ডামলা। তিনি বলেন, আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট এরদোগান খুব ভালোভাবে পরিস্থিতি সামলেছেন। যদি তিনি ইস্তাম্বুলে ফিরে না আসতেন, তাহলে আমাদের বেশিরভাগই এখন মৃত থাকতাম।
২২ বছর বয়সী ডামলা বলেন, আমি দেখিনি যে, জরুরি অবস্থার কারণে কারও স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। এটি মাত্র তিন মাসের ব্যাপার। আমার মনে হয় না এরদোগান ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন। আমার জীবনে পরিবর্তন বলতে এটাই হয়েছে যে, আগে কোনো অস্বস্তি ছাড়াই আমরা রাস্তায় যেতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা রাস্তায় যেতে ভয় পাচ্ছি। আগে আমরা বাচ্চাদের বাড়ির পাশে রাস্তায় খেলতে দিতাম, এখন তাদের জন্য আমরা আশংকার মধ্যে থাকি। আগে আমি ইচ্ছেমত চলাফেরা করতে পারতাম, কিন্তু এখন পারছি না।
নূরান, বই দোকানি
৭০ বছর বয়সী নূরান বলেন, সরকার ইতিমধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। তারা অনেক আইন করতে চাচ্ছে। যদি তারা একবার এসব আইন করে ফেলে, তবে তা বাতিল করা অনেক কষ্টকর হবে। এখানে আদালতের কাছ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। আমরা আমাদের ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছি। কারণ আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, উপহারও বই বিক্রি করি। আমরা এরদোগানকে বিশ্বাস করি না। আমাদের সন্দেহ তিনি হয়তো ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। এখানে হাজার হাজার মানুষের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, এ কারণে আমরা বিশ্বাস করি অভ্যুত্থান চেষ্টা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত নাটক।
বেতুল, ব্যবস্থাপক এবং মা
৪২ বছর বয়সী বেতুল একজন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপক। দুই ছেলের এই মা বলেন, আমি সরকারের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি এবং আমরা অনেকটাই ঘাবড়ে গেছি। আমরা খুই অনিরাপদ ও দ্বিধার মধ্যে আছি, কারণ আমরা জানি না যে অভ্যুত্থান চেষ্টাটি এরদোগান না তারা যাকে অভিযুক্ত (গুলেন) করছেন সেই ব্যক্তি করেছেন কি না।
তিনি বলেন, আমি সকালে এরদোগানের কাছ থেকে একটি এসএমএস পেয়েছি যাতে বলা হয়েছে, ‘মেহেরবানি করে রাস্তায় নামুন’, এটি দেখে আমি আরও ঘাবড়ে গেছি। আমি ভাবতেও পারি না যে কোনো প্রেসিডেন্টের এমন আচরণ করতে পারে কি না যিনি জনগণকে রাস্তায় যেতে বলতে পারেন। এটি আদতেই ঠিক নয়।আমি এরদোগানকে বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি তার কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত, এসব নিয়ে দেশের কিছুই করার নেই। সব কিছুই তার ব্যক্তিগত অর্জন। সে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তুরস্ক তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সে এই তমসাকে পরিপূর্ণ করতে অভ্যুত্থান চেষ্টাসহ সব কিছু করছে।
সেরাপ, গৃহিনী
৪৪ বছর বয়সী সেরাপ বলেন, এই দেশে যা ঘটেছে তা নিয়ে আমরা আতংকিত। আমরা চাই অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। আমরা চাই ফেতুল্লাহ গুলনকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করা হোক। প্রেসিডেন্ট এরদোগান খুবই সুন্দরভাবে অভ্যুত্থান চেষ্টাকে মোকাবিলা করেছেন। আমরা আমাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট। যাই হোক যুক্তরাষ্ট্র যদি গুলেনকে তুরস্কের কাছে ফেরত দেয় তাহলেই তাদের বন্ধু ভাববো আমরা।
তানের, নির্মাণ শ্রমিক
৪৬ বছর বয়সী তানের বলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ। আমরা অনেক বড় হুমকিকে পরাস্ত করেছি। তবে অধিকতর নিরাপত্তার জন্য আমাদের উচিত রাজপথ ও চত্বরগুলোকে খালি রাখা। এ কারণে অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিপূর্ণ অবসান না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। আমরা মনে করি এই অভ্যুত্থান চেষ্টার নেপথ্যে রয়েছে যু্ক্তরাষ্ট্র ও ফেতুল্লাহ গুলেন। এটি আমার মত। আমরা গুলেনকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনতে চাই। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় তিনি অভ্যুত্থান চেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত নয়, তবে তিনি মুক্তি পাবেন।
নুরগুল, ওয়েট্রেস
২৭ বছর বয়সী নুরগুল একজন কুর্দি ওয়েট্রস। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগান যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন, তাতে আমরা খুশি না। জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত মোটেই ঠিক নয়। তারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। কটি মোটেই সমাধান নয়। হ্যাঁ, এখানে একটি অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু জরুরি অবস্থার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে এরদোগান আরও ক্ষমতা কুক্ষিগত করবেন, এটি মোটেই ভালো ব্যাপার নয়। আমি একজন কুর্দি, আমি জানি জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করা বলতে কী বুঝায়? তাই আমি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার ঘর ছেড়ে যাচ্ছি। হ্যাঁ, আমরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি কারণ আমরা এমন এক সময়ে উপনীত হয়েছি যখন ভাবতেও পারছি না যে সামনের দিনগুলোতে তুরস্কে কী ঘটতে যাচ্ছে!
নুরদান, মা ও গৃহিনী
৩৫ বছর বয়সী নুরদান বলেন, রাষ্ট্রের উচিত খোলাখুলি বলা যে, নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে তারা কী চায়? গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। বোমার পর বোমা ফাটছে, যা দেখে জনগণ প্রেসিডেন্ট ও দেশ সম্পর্কে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তুরস্কে যা ঘটেছে তাতে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল জনগণ রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করছে, যা সত্য ছিল না। এ কারণে এরদোগান সফলভাবে পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছেন এবং আমরাও তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।