
এরদোয়ানের জয়ে তুরস্কের পরাজয়
ঢাকা, ২৭ জুলাই, (ডেইলি টাইমস ২৪):
চলতি মাসের ১৫ তারিখ রাতে তুরস্কের রাজধানী ইস্তামবুলে সেনাবাহিনীর একাংশ ক্যু করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সমর্থক ও অনুগত বাহিনীর প্রতিরোধে ক্যু’টি ব্যর্থ হয়। ক্যু ব্যর্থ হওয়ায় এরদোয়ান যে সফলতা পেয়েছেন তাতে আপাতত পুরো ঘটনার ব্যাপ্তি বোঝা না গেলেও, এটা ঠিক যে নিকট ভবিষ্যতেই তুরস্কের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক বৃহত্তর বিপদ। যদি অভ্যুত্থানকারীদের হাতে কোনোভাবে এরদোয়ান মৃত অথবা ধৃত হতেন তবে অল্প সময়ের ব্যবধানেই তুরস্কের অন্যান্য সব অঞ্চলের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসতো। তবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহন করলেও এরদোয়ানের একে পার্টির সমর্থকদের সঙ্গে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সেই সংঘাত গৃহযুদ্ধের আকার পর্যন্ত নিতে পারতো।
কিন্তু অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়া বা ব্যর্থ করে দেয়ার ফলে তুরস্কের ক্ষমতা কাঠামো আরও এক নায়কতান্ত্রিক হয়ে যাবে এবং এরদোয়ান হবেন তার প্রধান নায়ক। কারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যেই একটি ক্যু ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং জনগণের কাছে তিনি নিজের গণতান্ত্রিক চেহারা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও এই এরদোয়ানই তার দলের বাইরে সকল পার্টিকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তুরস্কে ক্যু হলে রাস্তায় শুধু একে পার্টির সমর্থকরাই নেমে আসেনি, পাশাপাশি সকল বিরোধী দলীয় সমর্থকরাও রাস্তায় নেমে এসেছিল। অন্তত এটা পরিষ্কার যে তুরস্কের সাধারণ জনগণ ১৯৯৭ সালের পর আর সামরিক অভ্যুত্থান দেখতে চাইছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এরদোয়ান সমালোচকের মতে, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ফলে তুরস্কে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র দুর্বলতর হবে এবং ক্যু হবার আগেই পরিস্থিতি খারাপ ছিল। নাম প্রকাশে ওই ব্যক্তি অনিচ্ছুক হওয়ার কারণে, বর্তমান তুরস্কের পরিস্থিতিতে এরদোয়ানের সমালোচনাকারীকে রাষ্ট্রীয় সাজার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। এমনকি ওই সমালোচকও মনে করছেন যে, ওই ক্যু’র জন্য আসলে দায়ি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ফেতুল্লাহ গুলেন। কারণ তার মতে, এধরনের ক্যু করার জন্য যে যোগাযোগ আর প্রভাব দরকার হয় সেটা ফেতুল্লাহ গুলেনের সমর্থকদেরই একমাত্র রয়েছে। এমনকি তুরস্কের নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরেও রয়েছে গুলেনের সমর্থক। তিনি আরও বলেন, ‘ফেতুল্লাহ আমাদের সাহায্য করেনি, তিনি আমাদের হত্যা করেছেন। আমাদেরকে এরদোয়ানের হাতে ফেলে রেখে তিনি পালিয়ে গেছেন।’
সমালোচকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গুলেনের সমর্থকরা মূরত দুইটি পন্থা অনুসরণ করে। বিভিন্ন স্কুল,- বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া এবং ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোতে তাদের একটা মধ্যপন্থী চেহারা রয়েছে। কিন্তু সবসময়ই তাদের রয়েছে একটি গোপন সংস্থা, যার কাজই হলো গোপনে সেনাবাহিনীতে, পুলিশে এবং নিরাপত্তা বাহিনীতে অবস্থান করে নেয়া। ১৯৮৭ সালের দিকে এমনই এক ক্যু হয়েছিল, যাকে তুলনা করা হয়েছিল রোমান ক্যাথলিক সংস্থা ওপাস দেইয়ের সঙ্গে। ওই সংস্থাটি গোপনে ফ্রাঙ্কো এবং অন্যান্য ডানপন্থী সরকারদের সঙ্গে আতাত করে চলতো। তুরস্কের এমন পরিস্থিতিকে ওই ক্যুর সঙ্গে হুট করে তুলনা করা না গেলেও, এটাতো দেখাই যাচ্ছে যে, গোপন একটা সংস্থা বা গোপন কেউ জড়িত।
ইস্তামবুলের ক্যু’টি আসলে পূর্ণ হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। অথবা বলা ভালো, ঠিক পরিকল্পনা মাফিক ক্যু করা হয়নি। অন্তত এমন একটি ব্যর্থ ক্যু আয়োজন করে দেশের সকল স্তর থেকে গুলেন সমর্থকদের উৎখাত করার কাজে এরদোয়ান মোটামুটি যে সফল হয়েছেন তা বলা যায়। কারণ সমর বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ক্যু ঘটাতে গেলে যে যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয় তার কোনোটিই হয়নি তুরস্কের ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছিল যে, রাতের আধারে একদল সেনাসদস্য আর্মি ড্রিল করতে রাস্তায় নেমেছিল। ১৫ তারিখ বেলা চারটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠজন ফোন দিয়ে জানা যে, ইস্তামবুলের বেইলেবেই প্রাসাদের কাছে সেনাবাহিনী গাড়ি থামাচ্ছে। এরদোয়ান পরবর্তীতে জানান, ‘আমার শ্যালক আমাকে জানায় যে, সেনাবাহিনী রাস্তায় অবস্থান নিচ্ছে এবং ব্রিজ অতিক্রম করে দিচ্ছে না কোনো গাড়িকে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, এমন ঘটনা ঘটছে। তখন আমি জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানকে ফোন দেই, কিন্তু তাদের ফোনে পাই না। এরপর আমি সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফকে ফোন দেই। তাকেও আমি ফোনে পাইনি। এটা স্পষ্ট হয় যে, তারা কেউই ফোনে উত্তর দেবার জন্য তাদের স্থানে নেই। তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি এবং কিছু সমস্যা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমার।’
ওই ঘটনার চার ঘণ্টা পর রাত আটটার দিকে এরদোয়ান মিডিয়াকে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। কারণ এরদোয়ানকে খুব কৌশলের সঙ্গে ব্যাপারটি দেখতে হয়েছিল এই জন্য যে, তুরস্কে এরদোয়ানের সমর্তক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিরোধীরাও। তবে শেষমেষ এরদোয়ানের পরিকল্পনাই সফল হয় এবং ক্যু ব্যর্থ হয়ে যায় সকলের অংশগ্রহনে। ব্যর্থতার কারণে কমপক্ষে ৬০ হাজার সৈন্য, বিচারক, আইনজীবি, সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের গ্রেপ্তার ও বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় এরদোয়ান কিভাবে তার দেশকে বিভক্ত করেন ক্যু প্রশ্নে। একদিকে ভঙ্গুর সেনাবাহিনী কাঠামো, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদে সংঘাত প্রশ্নে তুরস্কের ভবিষ্যত অবস্থান কি হবে সেটাই দেখার বিষয়।