
আহ! ন্যাশনাল আর্কাইভস
ঢাকা, ২ আগস্ট, (ডেইলি টাইমস ২৪):
সোমবার (১ আগস্ট) বেলা পৌনে ১২টা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল আর্কাইভস ভবনে অনায়াসে ঢুকে পড়লাম। ভবনের প্রবেশ মুখে সক্রিয় একটা ওয়াচওয়ে থাকলেও কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিল না। সঙ্গে থাকা ব্যাগটি ওলট-পালট করে দেখার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া গেল।
শ্বেতপাথরের ওপর মনোরম নকশায় তৈরি অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির অভ্যর্থনা-টেবিলস্পেস ফাঁকা। এখানেও নাম-ধাম-পরিচয় জানানোর বিড়ম্বনা পোহাতে হলো না। পুরো ভবন জুড়ে সুনসান নীরবতা! মনে হলো-কোথাও কেউ নেই!
এত বড় একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান! একেবারে কেউ না থেকে কী পারে? কৌতূহল নিয়ে নিচ তলার পূর্বপাশের সুবিশাল কক্ষে ঢুঁ মারলাম! সেখানে তিন টেবিলে তিনজন কর্মকর্তা খোশ গল্পে ব্যস্ত। কারো টেবিলে কোনো ফাইল বা কাগজপত্র নেই। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশ! যেন মামা বাড়ি!! এদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পত্রিকা দেখতে চাই। কোথায় গেলে মিলবে? সেগুলো দেখতে হলে কী করতে হবে?
অলস সময় পার করা সরকারের এই ‘মহান কর্মচারী’ যেন বিরক্ত হলেন একটু। বললেন, ‘এসব ব্যাপারে গবেষণা কর্মকর্তা বলতে পারবেন। তিন তলায় চলে যান।’
নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন ন্যাশনাল আর্কাইভস ভবনের লিফট ছিল চালু। তবে লিফটে কোনো আরোহীও নেই, অপারেটরও নেই। একেবারে ফাঁকা। উঠে পড়লাম লিফটে।
তৃতীয় তলায় উঠে চোখে পড়ল দেওয়ালে সাঁটানো কয়েকটি ফেস্টুন। যার একটিতে লেখা ‘শিক্ষা ও গবেষণার জন্য আরকাইভসের মূল্য অপরিসীম’। আরেকটিতে লেখা ‘জাতীয় আরকাইভসে আসুন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হউন’। আরেকটিতে লেখা, ‘শেকড়ের সন্ধ্যানে জাতীয় আরকাইভসে আসুন’।
কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে ন্যাশনাল আর্কাইভসে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেখানে গিয়ে নঁথি দেখা খুব দুরুহ ব্যাপার। বরং ন্যাশনাল আর্কাইভস-কে ‘মামা বাড়ি’ বানিয়ে ফেলা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভেজা লুঙ্গি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে ফিরে আসতে হবে আপনাকে।
সুন্দর কথায় সাজানো ওই ফেস্টুনের নিচে প্লাস্টিকের টেবিলে ভেজা লুঙ্গি নেড়ে রেখেছেন আর্কাইভসের কোনো এক কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী।
কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে গবেষণা কক্ষের দরজা ফাঁক করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। সেখানে গবেষণারত কাউকে দেখা গেল না। কেবল একজন কর্মচারী গবেষণা টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।
এতক্ষণ পর মনে হলো, ন্যাশনাল আর্কাইভসের মত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে এর কর্মচারীরা বেশ সজাগ। আমার ব্যাগটা ওলট-পালট করে দেখতে লাগলেন ওই কর্মচারী। জিজ্ঞেস করলেন ব্যাগের ভেতরে কী? আমি বললাম এতক্ষণ পর!
মূল গেটে চেক হলো না, ওয়াচওয়েতে চেক হলো না, অর্ভথ্যনার টেবিলে চেক হলো না, তিন তলায় আসার পর জানতে চাওয়া হলো- ব্যাগে কী?
গবেষণা কক্ষের ভেতরে লগিং টেবিলটাও ছিল ফাঁকা। কোনো গবেষক বা কৌতূহলী পাঠক আর্কাইভসে ঢুকে প্রয়োজনীয় নথি দেখতে চাইলে সহযোগিতা করার মত লোক সেখানে নেই। অথবা আছেন, কিন্তু অফিসে আসেন নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর জানা গেল, গবেষণা কর্মকর্তা মো. ইলিয়াছ মিয়া নিজ দপ্তর ছেড়ে পাশের একটি কক্ষে ‘গবেষণা কাজে’ ব্যস্ত! একজন কর্মচারীকে পাঠানো হলো তার কাছে। অত:পর গবেষণা কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে বললেন, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কোনো নঁথি দেখানো যাবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা আছে।
অন্য নথি দেখতে চাইলে অফিসের প্যাডে আবেদন করতে হবে। সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ন্যাশনাল আইডির ফটোকপি। এক দিনের জন্য জমা দিতে হবে ৫০ টাকা। পুরো বছরের জন্য জমা দিতে হবে ১০০ টাকা। ছবি তুলতে হলে প্রতি ছবির জন্য ১০ টাকা-ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এত ঝক্কি-ঝামেলা পোহায়ে সাধারণ কোনো পাঠক বা গবেষক ন্যাশনাল আর্কাইভসে আসে কি না জানতে চাইলে গবেষণা কর্মকর্তা মো. ইলিয়াছ মিয়া বলেন, সরকার যেটা নিয়ম করে দিয়েছে, তার বাইরে তো আমি যেতে পারব না।