
বদলগাছীতে হতদরিদ্রদের চাল যাচ্ছে স্বচ্ছল পরিবারে
ঢাকা, ০৫ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় সরকারের ‘খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির’ আওতায় হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণে দলীয় নেতাকর্মী ও চেয়ারম্যান মেম্বারদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় হতদরিদ্রদের পরিবর্তে রয়েছে দলীয় কর্মী ও চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের আত্মীয়-স্বজনের নাম, যাদের বেশিরভাগই স্বচ্ছল পরিবার। আবার যারা চাল পাচ্ছেন তাদেরকে ২-৩ কেজি করে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা য্য়, এ উপজেলায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্রদের মাঝে চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। হতদরিদ্র পরিবারের ৯৯৪ জনের একটি তালিকা করে উপজেলা খাদ্য অফিসে দেওয়া হয়েছে। তালিকা থেকে অনুসন্ধানে এলাকায় গিয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য। তালিকায় অধিকাংশ নাম রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বার ও দলীয় নেতাকর্মীদের আত্মীয় স্বজনের। আর স্বজনপ্রীতির কারণে যাদের নামে কার্ড দেওয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশই স্বচ্ছল, বাড়িতে পাকা ঘর রয়েছে কিংবা বয়স্ক ভাতা ও ভিজিডি প্রাপ্ত এবং চাকরিজীবী। এ ছাড়াও একই পরিবারের একাধিক সদস্যের নামেও কার্ড দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক হতদরিদ্র ব্যক্তির নাম তালিকায় থাকলেও স্বজনপ্রীতির কারণে তা কেটে দেওয়া হয়েছে অন্যজনকে।
এমন তালিকায় নাম রয়েছে আধাইপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সত্যপাড়া গ্রামের রিংকোন হোসেনের, যার রয়েছে পাকা বাড়ি, প্রায় ৮-১০ বিঘা জমি, একটি বড় মুদি দোকান ও একটি রাইসমিল রয়েছে। স্বজনপ্রীতির কারণে এই কার্ডটি দিয়েছেন ঐ ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার সাবিনা ইয়াসমিন । এ ছাড়াও তিনি তার আপন দেবর বেগুনজোয়ার গ্রামের উজ্জল হোসেনের নামে কার্ড দিয়েছেন, অথচ তার দোতলা পাকা বাড়ি ও ৫-৭ বিঘা জমি আছে। আবার একই ওয়ার্ডের তিলাবদলী গ্রামের জাহেরা বিবি ও তছির উদ্দীন এর নাম থাকলেও কার্ড পায়নি তারা। এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, স্বজনপ্রীতির কারণে নাম কেটে অন্য কাউকে কার্ড দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিলাশবাড়ি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের হলুদ বিহার গ্রামের দেলোয়ার হোসেন দুলুর বাবা গিয়াস উদ্দিন এবং মা জাহেরা দুজনের নামেই কার্ড দেওয়া হয়েছে। গিয়াস উদ্দিনের বয়স্ক ভাতার কার্ড রয়েছে। এ ছাড়াও যারা কার্ড পেয়েছেন, তাদের মধ্যে একই গ্রামের আদমের রয়েছে ইটের পাকা বাড়ি এবং জমির পরিমান প্রায় ৬ বিঘা। মুক্তিযোদ্ধা আজিজারের তিন ছেলে চাকরি করেন। দলীয় নীতিতে কার্ড পেয়েছেন রিপন, তার ইটের বাড়ি এবং জমি রয়েছে প্রায় ১২ বিঘার মতো। কোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক ফিরোজ আলম এবং দ্বীপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়া। আলেক স্বচ্ছল পরিবার এবং ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। বাবলু চাকরিজীবী।
কাশিমালা গ্রামের বেগম, সানজিদা, উজ্জল, রাসেল, কিনা, আলাউদ্দিন, রশিদ, ফজলুর স্বচ্ছল পরিবার, অনেকের বাড়িতে পাকা ঘর রয়েছে এবং চাকরি করেন। তবুও এরা কার্ড পেয়েছে দলীয় নেতা কর্মীদের স্বজনপ্রীতিতে। দুধকুড়ি গ্রামের মানিক হোসেন ও নুরুজ্জামানের স্বচ্ছল পরিবার। এ ছাড়াও তালিকায় রয়েছে একাধিক নাম ও ভুয়া নাম। আর ভূয়া নামের কার্ডের ব্যাক্তিদের এলাকাবাসী চেনেনও না। তালিকায় যাদের একাধিক নাম রয়েছে তারা দুইবার চাল নিয়েছেন। আবার যাদের ভুয়া নামে আছে তাদের কার্ড নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য ও দলীয় নেতাকর্মীরা চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যারা দলের পক্ষে কাজ করেছে তাদের নাম তালিকাবদ্ধ করে দলীয়ভাবে কার্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ হতদরিদ্ররা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা ১০ টাকা কেজি দরে চালের কার্ড পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা তালিকা প্রণয়নকারীদের কাছে তাদের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে ও ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।
আবার ডিলারদের বিরুদ্ধেও চাল কম দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হলে হতদরিদ্রদের পক্ষ হয়ে ডিলারের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়া ও চাল ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ করে। সব মিলিয়ে ১০ টাকা কেজি দরে চাল নিয়ে শুরু হয়েছে চালবাজি।
হলুদ বিহার গ্রামের হতদরিদ্র লুৎফর রহমান অভিযোগ করেন, ‘জোড়াতালি দেওয়া টিনের ঝুপড়ি ঘরে থাকি। প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি ও ছোট মেয়েকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছি। অন্যের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ না করলে দিন চলে না। অথচ আমার মতো অনেকেই ১০ টাকা কেজি দরে চালের কার্ড না দিয়ে যারা চেয়ারম্যান ও মেম্বারের পিছনে কাজ করেছেন তাদেরকে কার্ড করে দেয়া হয়েছে।’
স্থানীয় শহীদুল ইসলাম জানান, প্রকৃত হতদরিদ্রদের কার্ড না দিয়ে দলীয় নেতাকর্মী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা চাল পাওয়ার যোগ্য তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আগের তালিকা বাতিল করে পুনরায় নতুন করে তালিকা প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।
বিলাশবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান কেটু বলেন, ‘আমি বিরোধী দলের চেয়ারম্যান। দায়িত্বগ্রহণ করার পর ১ হাজার জনের একটি তালিকা পেয়েছি। যেটা আগের চেয়ারম্যান তৈরি করেছিলেন। সেখানে তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের নাম রয়েছে। কার্ড দেওয়ার নামে তারা অনেকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছেন বলে শুনেছি। তারা অনুরোধ করায় তালিকায় স্বাক্ষর করেছি। তবে তালিকা থেকে অধিকাংশ প্রকৃত হতদরিদ্র বাদ পড়েছেন।’
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ফারজানা পপি বলেন, হতদরিদ্র পরিবার বাছাই করে তালিকা তৈরি করেন উপজেলা পর্যায়ের সরকারি একজন কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব এবং ট্যাগ অফিসার সভাপতি। তালিকায় যদি স্বচ্ছল পরিবার থাকে সেটার দায়িত্ব ওই কমিটির। তবে তদন্ত কমিটি করে যাচাই করা হবে। আর এ ধরনের অনিয়ম পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’