আন্তর্জাতিক

ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’: সত্যি নাকি বিভ্রম?

ঢাকা, ২৩ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):

বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের পাকিস্তানি অংশে বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর দাবি গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ভাগে বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল।

এর কয়েকদিন আগে ভারত শাসিত কাশ্মীরের একটি সেনা ঘাঁটিতে এক হামলায় অন্তত ১৮ জন সৈন্য নিহত হয়।

ভারত এজন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামক ওই অভিযানকে তাদের সমর্থকেরা বর্ণনা করেন পাকিস্তানের জন্য একটি বহু প্রতীক্ষিত উচিত শিক্ষা হিসেবে।

কিন্তু ইসলামাবাদ এমন অভিযানের খবর নাকচ করে দিয়ে বলেছে এটি একটি ‘বিভ্রম’।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে রোববার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা।

খবরে বলা হয়, বিবিসির পক্ষ থেকে কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জানতে চেষ্টা করা হয়েছে ২৯শে সেপ্টেম্বর সকালে আসলে কি ঘটেছিল। ভারতীয় সৈন্যরা সেদিন কি করেছিল?

যদিও অভিযানটিকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, কিন্তু ভারতীয়রা অবশ্যই কাশ্মীরের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশের কথিত জঙ্গি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানোর লক্ষ্যে সেখানে বিমান থেকে সৈন্য নামায়নি।

তবে তারা স্থলপথে নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) অতিক্রম করেছিল।

কোন কোন ক্ষেত্রে তারা নিয়ন্ত্রণ রেখার এক কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত গিয়েছিল।

তবে পাকিস্তানের পুলিশ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন যে, শ্রীনগরের মাদারপুর-তিত্রিনট এলাকায় এমন স্থল হামলা হয়েছে।

এখানে একটি পাকিস্তানি চৌকি ধ্বংস হয়েছে এবং একজন সৈন্য নিহত হয়েছে।

লিপা উপত্যকার স্থানীয়রা বলছেন, ভারতীয়রা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ঢালের উপর অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।

সেখান থেকে অনতিদূরেই একটি পাকিস্তানী সীমান্ত চৌকি ছিল হামলার লক্ষ্য।

পাহাড়ের উপরিভাগের আরো দুটি সীমান্ত চৌকিও আক্রান্ত হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ভোর পাঁচটা থেকে তিন ঘণ্টা ধরে চলা হামলায় চার জন পাকিস্তানি সৈন্য আহত হয়। নিলুম উপত্যকায়ও একই রকম স্থল হামলা চালায় ভারতীয়রা।

তবে পাকিস্তানী সৈন্যরা এসব হামলাকে সাধারণ আন্তঃসীমান্ত গোলাগুলির বেশী কিছু বলতে নারাজ।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই এলাকার ভূপ্রকৃতি এমন যেখানে ভারতীয় সৈন্যদের পক্ষে সেখানে পৌঁছে কোন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে আবার জীবিত ফিরে আসতে পারাটা সম্ভব নয়।

ভূপ্রকৃতিগত কারণে হেলিকপ্টার থেকেও এয়ারড্রপ কিংবা এয়ারলিফ্ট করা সম্ভব না, কারণ তার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হেলিকপ্টারগুলো ফেলে দেবে।

তাহলে কি হয়েছিল সেদিন আসলে। কোন পক্ষের দাবীই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ফলে উপসংহারেও পৌঁছানো যাচ্ছে না। দুই পক্ষের দাবির মাঝামাঝিই হয়তো সত্য লুক্কায়িত আছে।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিপা উপত্যকার মুনডাকালি গ্রামের বাসিন্দা আলী আকবর। তিনি প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে ওঠেন। ওইদিন উঠেই শুনতে পান গোলাগুলির শব্দ। কমপক্ষে একশ রাউন্ড গুলি। হালকা অস্ত্র ছিল সেগুলি।

তিনি বলেন, আমি যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছি এবং দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধক্ষেত্রেই বসবাস করি। অতএব আমি জানি, ভারি অস্ত্রের গুলি মানেই সমস্যা। তাতে আমাদের গ্রাম আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ততক্ষণ, যতক্ষণ না চারটি বোমার আওয়াজ শুনলাম। তারপর কয়েক মিনিট বাদে আরো চারটি বোমা। আমার স্ত্রী আমাকে তখন তাড়া দিল বাঙ্কারের ভেতরে চলে যেতে। এমন দিনের জন্যই বাড়ির পাশে বাঙ্কারটি খুঁড়েছি আমি।

হালকা অস্ত্রের গুলি তখনও বন্ধ হয়নি। এটাই আমাকে বিস্মিত করে। তারা কার্যত নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেছে এবং খাঁড়ির উপর অবস্থান নিয়েছে। আমার মাথার উপর দিয়ে শিস কেটে গুলি চলে যাচ্ছিল।

আলী আকবর বলেন, “গত ত্রিশ বছরে এই প্রথম তারা এমন একটি অবস্থান থেকে গুলি বর্ষণ করল”।

অনেক জায়গাতেই ভারতীয়দের হামলা ছিল আচমকা। লিপা উপত্যকার গ্রামবাসীদের সাথে কথাবার্তা বলে এটা স্পষ্ট, গুলিবর্ষণ প্রথম শুরু হয় স্থানীয় সময় ভোর ৫ টায়।

সেখানকার হামলায় মুন্ডাকালি গ্রামের পার্শ্ববর্তী সেনা চৌকি এবং তার পাশের একটি মসজিদে আগুন ধরে যায়।

সকালের নামাজের জন্য প্রস্তুতিরত একজন সৈন্য এসময় গুলিবিদ্ধ হয়।

মসজিদে লাগা আগুন দশ-বারোজন গ্রামবাসীর প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে।

আহত সৈন্যটিকে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে একটি সেনা হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিলুম উপত্যকার আশপাশের গ্রামবাসীরা অবশ্য গুলির আওয়াজ ভাল শোনেনি। অনেকের ঘুমই ভাঙেনি।

ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে অবগত এমন একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেছেন, ভারতীয়দের উপস্থিতি যখন পাকিস্তানি বাহিনীর নজরে এসেছে তখন তারা বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

তিনি বলেন, “পাকিস্তানিরা পাল্টা গুলি শুরু করলে তারা পিছু হটে নিজেদের বাঙ্কারে ফিরে যায়”

পুঞ্চ, কোটলি এবং ভিমবার এলাকা থেকে পাওয়া কর্মকর্তাদের বক্তব্যও কমবেশি একই।

বহু বছর ধরেই কাশ্মীর কেন্দ্রিক জঙ্গিদের একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে।

যদিও ভারতীয় গণমাধ্যম দাবি করেছে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ার, কিন্তু বিবিসির অনুসন্ধানে এর সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ তেমন একটা পাওয়া যায়নি।

এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমে লিপা উপত্যকায় লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটি হামলার শিকার হবার যে খবর দিয়েছে তারও সত্যতা মেলেনি।

তবে, দুধনিয়াল এলাকার কিছু গ্রামবাসী বলেছেন, তারা জঙ্গিরা ব্যবহার করতো বলে ধারণা রয়েছে এমন দুএকটি অবকাঠামো দেখেছেন, যা ভারতীয়দের হামলায় ধ্বংস হয়েছে।

কিন্তু সেখানে আদৌ কোন জঙ্গি ছিল কি না, কিংবা তাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে কি না, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে এই গ্রামবাসীরা অনীহা পোষণ করেন।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ওই এলাকার জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এদিকে লিপা উপত্যকার গ্রামবাসীরা বলেছেন, ২৯ সেপ্টেম্বরের হামলার পর ওই এলাকায় হঠাৎ করে জঙ্গিদের আনাগোনা বেড়ে গেছে।

তারা কি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করবার জন্য ওই এলাকায় জড়ো হচ্ছে? সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

নিলুমে জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা চলতি মাসের শুরুতে গ্রামবাসীদেরকে একটি বৈঠকে ডেকে তাদের প্রত্যেকের বাড়ির পাশে বাঙ্কার খোঁড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

ওই বৈঠকে যোগ দেয়া একজন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক বলেছেন, ভারতীয়দের গোলাবর্ষণ থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করার চাইতে কম ব্যয়বহুল ও সহজতর উপায় হচ্ছে ওই এলাকা থেকে জঙ্গিদের হঠিয়ে দেয়া।

তবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কৌশলটি গোপনীয়। এমন কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার মালিক সরকার।

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button