
একদিকে দুর্নীতি অন্যদিকে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব
ঢাকা, ২৫ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):
প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর বাড়ানোর প্রস্তাব একনেকে উঠতে পারে আজ * অনেক স্থানেই হতদরিদ্রের সুবিধা ভোগ করছেন ক্ষমতাসীন দলের সচ্ছল নেতাকর্মী * ঋণের মোটা অংকের অর্থ খেলাপি
দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার’-এ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
প্রকল্প চালুর পরপরই উত্থাপিত এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, অনেক স্থানেই হতদরিদ্রের ঋণ সুবিধা চলে গেছে সমাজের প্রভাবশালী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের পকেটে। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হলেও তা ছাড়াই দেয়া হচ্ছে প্রকল্পের ঋণ। এর মধ্যে কেউ কেউ কিস্তি শোধ না করে তারা চলে গেছেন বিদেশে। এমনকি নীতিমালা ভঙ্গ করে ঋণের টাকা খরচ করা হচ্ছে ভিন্ন খাতে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঋণের মোটা অংকের টাকা খেলাপি হয়েছে।
এছাড়া কোনো কোনো স্থানে হতদরিদ্রের গরু, ছাগল ও ঢেউটিন জনপ্রতিনিধির স্বজন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পেয়েছেন বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি ১০ একর জমি, দোতলা বাড়ি, বাজারে ২৩টি পাকা দোকানের মালিকও হয়েছেন প্রকল্পের সমিতির সদস্য। যা নীতিমালার সুস্পষ্ট লংঘন। বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ এক একর জমির মালিকই এ সমিতির সদস্য হতে পারবেন। যুগান্তরের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
উল্লিখিত অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিকার না করেই ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মেয়াদ আরও ৪ বছর বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। এটি অনুমোদনের জন্য আজ (মঙ্গলবার) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপন করা হতে পারে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। একনেকের সম্মতি পেলে প্রকল্পের পাশাপাশি নবগঠিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রমও চলবে। এজন্য ব্যাংকটির আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। ব্যাংকটির আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষে প্রকল্পের সম্পদ ও দায়দেনা নিয়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। সে মোতাবেক, প্রকল্পের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হওয়ায় গত ১ জুলাই ব্যাংকটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্পে সমিতি গঠনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রায় ২২ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য স্থায়ী তহবিল গঠন করা হয়েছে। আরও ৩৬ লাখ লোকের স্থায়ী তহবিল গঠনের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি দাবি করেন, প্রকল্পের ছোটখাটো শেখ হাসিনা দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের সমিতি গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয়। যাতে সমিতির সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করে নিজেদের সচ্ছলতা আনতে পারে। সদস্য সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, হতদরিদ্র থেকে সর্বোচ্চ ৩ বিঘা জমির মালিক এ সমিতির সদস্য হতে পারবেন। প্রতিটি সমিতির সদস্য হবে ৬০ জন। এর মধ্যে ৪০ জন নারী ও ২০ জন পুরুষ। সদস্যরা প্রতি মাসে ২০০ টাকা সঞ্চয় জমা রাখবেন। তার বিপরীতে প্রকল্পের পক্ষ থেকে তার অ্যাকাউন্টে ২০০ টাকা জমা হবে। যারা নিয়মিত সঞ্চয় জমা রাখবেন তারাই শুধু প্রকল্পের ঋণসহ যাবতীয় সুবিধাভোগী হবেন। সমিতি থেকে ঋণ নিতে হলে যে খাতে ঋণ নিবেন সে বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে সমিতি থেকে ঋণ দেয়া যাবে না।
১৯-২১ মার্চ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মিহির কান্তি মজুমদার নড়াইল ও পিরোজপুর জেলার কয়েকটি সমিতির কার্যক্রম পরির্দশন করেন। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে তিনি বলেন, অধিকাংশ সমিতি সমবায় হিসেবে নিবন্ধিত না হওয়ায় নিজস্ব তহবিল সৃষ্টি হয়নি। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন ২০১৪ এর বিধান মতে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ৪৯ শতাংশ হবে সমিতির অংশ। কিন্তু এখনও তা সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন খামার করার নামে ঋণ নিলেও তা করেননি সদস্যদের অনেকে। নার্সারির কথা বলে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিদেরও ঋণ দেয়ার নজির রয়েছে, যা নীতিমালা পরিপন্থী। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার সাতকাছিমা গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ জন সদস্যের একজন সুখী সুলতানা। মাছচাষের প্রশিক্ষণের পর ২০ হাজার টাকা ঋণ নিলেও তিনি কোনো মাছের খামার করেননি। বর্তমানে দর্জির কাজ করে সংসার চলছে তার। অপর সদস্য মুসলিমা বেগম হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি সমিতি থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। কিন্তু আজ অবধি কোনো খামার তৈরি করেননি।
এ প্রসঙ্গে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মিহির কান্তি মজুমদার বলেন, এ কর্মসূচি পরিদর্শনকালে বেশ কিছু অসংগতি পাওয়া গেছে। তা প্রতিবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আকবর হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতে সম্পদ বিতরণের সময় গরু, ছাগল, ঢেউটিন দরিদ্রদের পরিবর্তে সচ্ছল ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে নেয়। তবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম কমে এসেছে। একেবারে দূর হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এসব অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে, আমরা তা শুনেছি। যেসব অভিযোগ উঠেছে তার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। মানুষের হৃদয়-মন জয় করার কথা বলেছেন। তা করতে হলে সরকারকে এসব অভিযোগের বিহিত করতে হবে। আমরা আশা করব সরকার তা করবে।
প্রকল্পের নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের ওপর বিভিন্ন ব্যুরো ও জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য তথ্য নিচে দেয়া হল-
রাজশাহী : পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের তানোর উপজেলার সরনজাই ইউনিয়নের সুকদেবপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সভাপতি দলিল লেখক জাইদুর রহমান। তিনি বর্তমানে ওই গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ৮ বিঘা জমির মালিক। তার সঙ্গে রয়েছেন ওই ওয়ার্ডের মেম্বার আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন। এ দু’জন প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প শুরুর দিকে সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকা উত্তোলন করে সমিতির ম্যানেজার ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম সরদার ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করেন। এরপর তারা দায়িত্বে এসে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সমিতির সুবিধাভোগী সদস্য করেছেন। আগে মাসুদ রানা নামে এক সদস্য গবাদি পশু পালনের নামে ঋণ নিয়ে আজও পরিশোধ করেননি। তার মতো ওই সমিতিতে ১০-১২ জন সদস্য ঋণ খেলাপি আছেন।
একই উপজেলার তান্দুরিয়া ইউনিয়নের জুুড়ানপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ম্যানেজার (সেক্রেটারি) সাইদুর রহমান জানান, তিনি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের খুব কাছের লোক। আওয়ামী লীগ করেন বলে চেয়ারম্যানের সুপারিশে তাকে সমিতির ম্যানেজার/সেক্রেটারি করা হয়েছে। দু’জন সদস্য ছাড়া সবাই তার সমিতির আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। এখানে কোনো ঋণ খেলাপি নেই।
এছাড়া পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের তালান্দার ইউনিয়নের সেলামপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ম্যানেজার (সেক্রেটারি) জাহাঙ্গীর আলম। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ৬ বিঘা জমির মালিক। তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, প্রকল্প শুরুর সময় সমন্বয় করে সমিতি করা হয়। পরে উপজেলা সমন্বয়কারী হাবিবুর রহমানের চাপে ৬০ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় সদস্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। ৬০ জনের মধ্যে নারী সদস্য ২৮ জন রয়েছেন। বাকি ৩২ জন পুরুষ সদস্য। তবে তার সমিতির সভাপতি রয়েছেন জামায়াত নেতা গোলাম মুর্তুজা। শুধু এসব সমিতিতে নয়, প্রত্যেক সমিতিতে প্রায় সদস্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যে স্বপ্ন নিয়ে দারিদ্র্যকে জয় করার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের, সেই স্বপ্নের ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি ৮ বছরে। উপজেলার পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ৬৩টি সমিতির সদস্যদের মাঝে ঋণ ও সঞ্চয় আদান-প্রদানে স্থবির রয়েছে। এ কারণে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতিগুলোয় দেয়া অনুদানের ও ঘূর্ণায়ন তহবিলের প্রায় পৌনে ৪ কোটি টাকার হদিস নেই। প্রায় পুরো টাকাই খেলাপি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দাবি, ব্যাংকে এসব টাকা সুরক্ষিত রয়েছে।
এ ব্যাপরে তানোর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী বা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, সমিতির আন্তর্ভুক্ত সদস্যরা মাসে ২০০ টাকা সঞ্চয় জমা রাখলে আরও ২০০ টাকা লাভ পেয়ে থাকে। গবাদিপশু পালন, কৃষি ও মৎস্যসহ ৪৫টি খাতে সমিতির একজন সদস্য সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ঋণ সুবিধা পাবেন। তিন মাস মেয়াদে দুই শতাংশ ও এক বছর মেয়াদে আট শতাংশ সুদ আদায় করা হয়। কিস্তির ঝামেলা ছাড়াই প্রজেক্ট অন্তে আয় থেকে দায় পদ্ধতিতে পরিশোধ করা হয়। সমিতির সদস্যরা ম্যানেজার নিযুক্ত করে দেখভাল করে থাকেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
যশোর ব্যুরো জানায়, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে কিস্তির টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সদর উপজেলার চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নে এ প্রকল্পের একটি সমিতির সেক্রেটারি আনিসুর রহমান জানান, সেক্রেটারি থাকাবস্থায় সমিতির ৬০ জন সদস্যের কাছ থেকে আদায় করা কিস্তির টাকা উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়ে গেলেও তিনি কোনো রসিদ দেননি। পরে নোটিশ দেয়া হয়, আমার কাছে দুই লাখ টাকা পাওনা আছে। উপজেলা অফিসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তাদের কিছু করার নেই। জরিমানাসহ দুই লাখ টাকা আনিসকে শোধ করতে হবে। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে কিস্তিতে পাওনা টাকা পরিশোধের অনুমতি নিয়ে এখনও সেই টাকা শোধ করছি। প্রকল্পের যশোর সদর উপজেলা সমন্বয়ক দাউদ হোসেন বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে প্রকল্পের শুরুতে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক সচ্ছল ব্যক্তি সদস্য হয়েছিল। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ায় তা যাচাই-বাছাই করে বাদ দেয়া হয়েছে।
মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, এ জেলায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প শুধুই কাগজে-কলমে। শর্ত লংঘন করে প্রকল্পের সমিতির সদস্য করার অভিযোগ রয়েছে। সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬০ জনের জায়গায় মাত্র ৩৩ জন। সমিতির সভাপতি সিদ্দিক আলীর গ্রামে পাকা দালানবাড়ি রয়েছে। মাঠে ৫ বিঘা জমি রয়েছে বলে স্বীকারও করেন যুগান্তরের কাছে। এ কমিটির সেক্রেটারি সুন্নত আলী ছাগল পালনের নামে সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলেও অন্য কাজে টাকা লাগিয়েছেন। এ কারণে তাকে সেক্রেটারি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে গ্রামের ১২ বিঘা জমি ও দোতলা বাড়ির মালিক নাজমুল হুদাকে সেক্রেটারি করা হয়েছে। সমিতির সদস্য মাবুদ হোসেন ২০ বিঘা জমির মালিক। তাকে ভূমিহীন হিসেবে সদস্য দেখানও হয়েছে। এ সমিতির ৩৯ জন সদস্য গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ১০ হাজার টাকা করে ঋণ নিলেও তারা টাকা অন্য কাজে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিটির ৬ নম্বর সদস্য আলী হোসেন ১০ বিঘা জমির মালিক, আছে তার পাকাবাড়ি। কমিটির ২৮ নম্বর সদস্য পারুলা পারভিন। তার স্বামী সোনা মিয়ার মাঠে ১৫ বিঘা জমি আছে। মেহেরপুর সদর উপজেলা সমন্বয়কারী আলমগীর কবির বিষয়টি স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের সদস্যদের কেউ কেউ ছাগল-গরু পালনের নামে নেয়া ঋণের টাকা অন্য কাজে লাগিয়েছে।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, এ জেলায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অর্থ নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে। হতদরিদ্রদের গরু, ছাগল, ঢেউটিন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন ও বিত্তবানদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের মাঝে কল্যাণ অনুদানের নামে ১০০ জনকে ২০ হাজার টাকা মূল্যের একটি করে গরু, ৩০ জনকে ১ হাজার টাকা মূল্যের হাঁস-মুরগি, ৪৪ জনকে ১০ হাজার টাকা মূল্যের ঢেউটিন, ১০০ জনকে ১ হাজার টাকা মূল্যের গাছের চারা, ১০০ জনকে ১ হাজার টাকা মূল্যের সবজি বীজ বিতরণ করা হয়। ঢেউটিন পেয়েছেন তৎকালীন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল ফজল মাস্টারের ভাতিজা ফেরদৌস মাদবর, তারই আত্মীয় আ. জলিল ফকির, খালেক মাদবর, আজিজ মোল্যা, করমালি মাঝি, খোকন মাদবর, আ. জলিল পেদা ও আ. সাত্তার মাঝি। ভাইস চেয়াম্যান গোলাম মোস্তফার আত্মীয় চরযাদবপুর গ্রামের এনামুল হক সিকদার, রমি মোল্যা, কোব্বাস মোল্যা, নিজাম মোল্যা, ফজলে সিকদার, আ. মান্নান সিকদার, জব্বার মাদবরসহ অনেকেই। এ প্রসঙ্গে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, এ অনিয়মের জন্য আমরা দায়ী নই। আমরা শুধু ইউনিয়ন সিলেকশন করে দিয়েছি। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল ফজল মাস্টার বলেন, এ বিতরণ অন্যায়ভাবে করা হয়েছে। অন্যায় কাজে আমি সমর্থন করি না। তবে ফেরদৌস মাদবরের বাবা নেই, এ কারণে তাকে দেয়া হয়েছিল। শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মিরান সরদার জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম এর কারণ বলতে পারবেন।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, প্রকল্পের ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে খরচ করার অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ না দিয়েই ঋণ দেয়া হয়েছে। জেলার সদর ও নাজিরপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৮০ জন সদস্য ও সদস্যার মাঝে জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাতকাছিমা গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশ সদস্যের প্রশিক্ষণ নেই, আবার যে খাতের জন্য ঋণ গ্রহণ করেছেন তা ভিন্ন খাতে ব্যয় করেছেন। ওই সমিতির সদস্য কাঠ ব্যবসায়ী মো. জিয়াউদ্দিন সেখ (৫৩) ২০ হাজার টাকার ঋণ নিলেও তিনি কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। জুলেখা বেগম (৫২) হাঁস-মুরগির ওপর প্রশিক্ষণ না পেলেও তিনি ঋণ নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। তিনি বর্তমানে কেঁচো সার (কম্পোস্ট) তৈরি করছেন। শ্রীরামকাঠি ইউনিয়ন গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য হালিমা বেগম মাছ চাষের জন্য ঋণ নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। মাছে ব্যবসার ক্ষতি হওয়ায় তিনি এখন ধানের ব্যবসা করেন। সদর উপজেলার জুজখোলা ইউনিয়নের ছোট জুজকোলা গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৩০ জন সদস্য তিন লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যই কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। এই সমিতির সভাপতি মো. মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তিনি কাপড়ের ব্যবসার জন্য ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলেও কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। এসব অভিযোগ স্বীকার করে নাজিরপুর উপজেলার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সমন্বয়ক মো. আনিসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তদারকিতে কিছুটা ভুল ছিল। পরে এসব ভুল যাতে আর না হয় সেদিকে নজর রাখা হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে চলছে অর্থের হরিলুট। বিতরণকৃত ঋণের টাকা যেমন সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না, তেমনি খেলাপি টাকা আদায়ে নেই কার্যকর উদ্যোগ। যার কারণে দিন দিন বেড়ই চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ প্রসঙ্গে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী মো. মাহাবুবুর রশিদ তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে এ প্রকল্পের অধীনে বিতরণকৃত ঋণ আদায়ের হার প্রায় ৬০ শতাংশ। এখানে মাসিক কিস্তিতে ঋণ আদায় করা হয়। বেসরকারি এনজিওর মতো সপ্তাহে ঋণ আদায় না করা এবং ঋণ গ্রহীতাদের ওপর টাকা আদায়ে বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করায় ঋণ আদায় শতভাগ হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমন্বয় ও উন্নয়ন’ সংক্রান্ত এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রকল্পের সম্প্রসারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। প্রকল্প এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক উভয় প্রতিষ্ঠানই একসঙ্গে চালু থাকবে। এজন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। আইন অনুযায়ী একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিণত সমবায় সমিতিগুলোর দায়িত্ব নেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। ২২ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিবের নেতৃত্বে সমবায় মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কর্মপরিকল্পনার খসড়ায় ২০টি সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হবে। নতুন করে আরও ৩৬ লাখ দরিদ্র পরিবারকে সমবায় সমিতির মাধ্যমে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাদের সঞ্চয়, বোনাস ও আবর্তক তহবিলের সমুদয় অর্থ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমা থাকবে। প্রকল্প কার্যক্রম শেষে পর্যায়ক্রমে ওই তহবিল পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে সমিতির অনুকূলে স্থানান্তরিত হবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ প্রকল্পের সব সম্পদ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করবে।
দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলীর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি গ্রহণ করে সরকার। সরকারি অর্থায়নে ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের মেয়াদ প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর একনেক প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। পরে তা ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৩ হাজার ১৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় এবং ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ধরে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন করা হয়। বর্তমানে ব্যয় ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় ৮ হাজার ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেই সঙ্গে বাস্তবায়ন মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯০টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়নের ৪০ হাজার ৯৫০টি ওয়ার্ডে প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।