
ফলাফল কুদ্দুস বয়াতির ক্ষোভ আর দর্শক হতাশা
ঢাকা, ১৩ নভেম্বর, (ডেইলি টাইমস ২৪):
শনিবার (১২ নভেম্বর) মধ্যরাতে শেষ হলো তিন দিনের ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্ট-২০১৬’। ফলাফল দাঁড়িয়েছে- দেশের অন্যতম লোকসংগীতশিল্পী কুদ্দুস বয়াতীর ক্ষোভ আর দর্শক হতাশা।
আসরের প্রথম দু’দিন মন্দের ভালো জমলেও শেষ দিনে এসে এবারের আসর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। স্টেডিয়ামের গ্যালারি বেয়ে এসেছে দুয়োধ্বনিও! এবার চমকহীন-ভুল শিল্পী বাছাই এবং বাংলাদেশি লোকশিল্পীদের অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে ঘুরেফিরে; অন্তর্জালে এবং মাঠে আগত শ্রোতাদের মুখ থেকে। যা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে গেল রাত সমাপণী অনুষ্ঠানে ভারতের নুরান সিস্টার্স’র ‘কাওয়ালি’ (ফোক মঞ্চে মনমুগ্ধকর কাউয়ালি!) পরিবেশনা, দেশের সংগীতদল তাপস অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের ‘ভুয়া’ তকমা পাওয়া (গানের চেয়ে অতিকথন) পারফর্মেন্স এবং একই দলের হয়ে তিন মিনিটের জন্য মঞ্চে সুযোগ পাওয়া কুদ্দুস বয়াতীর আবেগঘন ক্ষোভ প্রকাশ।
তবে এর আগে বলে নিতে হবে দেশের বরেণ্য শিল্পী বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠ-বাঁশিতে অসাধারণ পরিবেশনার কথা। প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের মমতাজ ও কৈলাশ খেরের অনন্য পরিবেশনার ধারবাহিকতাই বলা যায় বারী সিদ্দিকীর উপস্থিতি। কণ্ঠে কাওয়ালি গান হলেও শেষ রাতে নুরান সিস্টার্স’ও পেয়েছে হাততালি। তবে এ পর্যন্তই যেন ফোক ফেস্ট থেকে প্রাপ্তি। কারণ এরপরই দশর্কদের অন্যভাবে দেখা গেল।
তখন মঞ্চে তাপস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস। ফ্রেন্ডস বলতে দেশ এবং বিদেশের নামকরা বেশ ক’জন মিউজিশিয়ান। দলের শুরুটা বেশ ছিল। মাঠে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে তাপস ধরলেন সৈয়দ আব্দুল হাদীর সেই বিখ্যাত গান- আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার বারিস্টার…। জমে উঠলো। উপস্থিত দর্শকরা ধরেই নিলেন, বিদেশিদের ছাপিয়ে দেশের ছেলে তাপস বুঝি এবারের ফোক ফেস্টে আলাদা চিহ্ন রাখবেন। মেটাবেন দেশের অর্ণব কিংবা বিদেশ পাপনের ফোক-ফিউশন ঘাটতি।
না, তা আর হলো না। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে তাপস গানের চেয়ে কথাই বললেন বেশি। উপস্থিত অনেক দর্শকের মতে যা হলো- লেজে গোবর! সুর-বেসুরের প্রসঙ্গ তখন আলোচনাতীত। বিস্তর কথার ফাঁকে ফাঁকে কয়্যার শিল্পীদের সহযোগিতায় কয়েকটি গান গাইলেন তাপস। মাঝে মঞ্চে ডাকলেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী ঐশীকে। তিনিও ফোক বাদ দিয়ে একটা সুফি ঘরানার গান উপহার দিলেন সবাইকে! এরপর চিশতী বাউলকে এনেও তথৈবচ অবস্থা। পুরো মাঠ থেকে একটা সময় সমস্বরে উচ্চারিত হতে থাকলো ‘ভুয়া… ভুয়া…’ ।
শনিবার রাত ১২টা বাজার দুই মিনিট বাকি তখন। তাপস অ্যান্ড ফ্রেন্ডসকে থামাতে এবং অন্যশিল্পীদের মঞ্চে ওঠাতে কিংবা আগত দর্শকদের ‘সান্ত্বনা’ দিতে হুট করে মঞ্চে চলে এলেন অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা। তিনি তাপস অ্যান্ড ফ্রেন্ডসকে ধন্যবাদ দিয়ে- তাদের নির্ধারিত সময় শেষের কথা জানালেন। ঠিক তখনই তড়িঘড়ি করে তাপস তার শেষ পরিবেশনার জন্য মঞ্চে ডেকে তোলেন বাউল কুদ্দুস বয়াতিকে। দর্শকদের এই বলে থামান, এখন কুদ্দুস বয়াতি পরিবেশন করবেন তার বিখ্যাত গান ‘পাগলা ঘোড়া রে’।
এবারের ফোক ফেস্টের সবচেয়ে বড় বোমাটা ফাটে তখনই। ফোক ফেস্টকে ঘিরে গেল তিন দিন ধরে অন্তর্জালে ভাসমান অসংখ্য প্রশ্ন-সমালোচনার দাবানলে যেন দক্ষিণা বাতাসের পর্যাপ্ত যোগান দিলেন দেশের অন্যতম এই লোকসংগীতশিল্পী।
সময় কম, মঞ্চ ছাড়তে হবে এখনই- তবুও তিনি গান শুরুর আগে হাসতে হাসতেই নিজের চিরাচরিত ভাষায় সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আমি ধন্য হয়েছি আজকে। কারণ তাপস আমাকে তার দলে এবং তার ব্যান্ড সংগীতের সঙ্গে রাখছে। আমি জীবনে কোনওদিন ভাবছিলাম না- আমি এই বিদেশিরার সঙ্গে গান গাইয়াম।’
পেছনে দাঁড়ানো বিদেশি মিউজিশিয়ানদের দেখিয়ে এই অবহেলিত অথচ নন্দিত বাউল বললেন, ‘আমি যে বিদেশি ডাকলাম- হেরা কিন্তু বুঝছে না!’
গান নয়, একজন কুদ্দুস বয়াতির এমন কথোপকথনে পুরো স্টেডিয়াম তখন মুহুর্মুহু করতালিতে টগবগ করে ফুটছিল। সবাই অপেক্ষায় তখন- তার কণ্ঠে ‘পাগলা ঘোড়া’ গানটি শোনার জন্য। অন্যদিকে পেছন থেকে মঞ্চ ছাড়ার জন্য আয়োজকদের তাড়াও রয়েছে। তাই মিউজিশিয়ানরা যখন তাপসের ইশারায় মিউজিক শুরু করে দিলো- তখনই কুদ্দুস বয়াতির দরাজ অভিমানী কণ্ঠ- ‘বাজাইয়ো না, বাজাইয়ো না। আমারে একটু কথা কইতে দ্যাও।’
এই বলে তিনি যা বললেন সেটি শুনে হয়তো ক্ষণিকের তরে পিনপতন নীরবতা নামে স্টেডিয়াম হয়ে মাছরাঙা টিভির সরাসরি লাইভ ধরে বিশ্বজোড়া বাংলা হৃদয়ে।