জাতীয়

এমসিসি’র মূল্যায়ন দুর্নীতিসহ ১০ সূচকে রেড জোনে বাংলাদেশ এবারও বঞ্চিত মোটা অংকের মার্কিন অনুদান থেকে

ঢাকা, ২২ নভেম্বর, (ডেইলি টাইমস ২৪):

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) মোটা অংকের অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও স্কোরের উন্নতি না হয়ে অবনতি হচ্ছে। দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নেতিবাচক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রকাশিত সর্বশেষ স্কোরে বাংলাদেশ দুর্নীতি, রাজস্ব নীতিসহ ১০টি সূচকে রেড বা লাল তালিকায় রয়েছে। যদিও গত বছর লাল তালিকায় ৯টি সূচক ছিল। চলতি বছরের তথ্য অনুযায়ী উন্নতির চেয়ে সূচকে অবনতি হয়েছে বেশি। এর ফলে অনুদান পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে আরও পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, প্রতিবছরই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)। শর্ত অনুযায়ী প্রত্যাশিত অনুদান পেতে হলে অধিকাংশ সূচকেরই সবুজ সংকেত স্কোর প্রয়োজন। চলতি বছর বাকি ১০টি সূচক গ্রিন বা সবুজ তালিকায় থাকলেও বেশিরভাগ সূচক নেতিবাচক থাকায় কোনো সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। যদিও সূচকের উন্নতি ঘটাতে কাজ করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।

 লাল তালিকায় থাকা সূচকগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব নীতি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার মান, বাণিজ্য নীতিমালা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয়, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং তথ্যের স্বাধীনতা। অর্থাৎ এসব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়।

সূত্রমতে, দীর্ঘ কয়েক বছর চেষ্টা করেও সূচকে উন্নতি না হওয়ায় একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল ইআরডি। এখন আবার নতুন করে বিষয়টি নিয়ে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় উন্নতি না হয়ে বরং আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে চাপিয়ে রাখায় নতুন করে রেড জোনের সূচক বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার তথ্য নিয়ে এমসিসি নিজেরাই এই মূল্যায়ন করে। অনেকে মনে করেন এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির বিষয়টি তো বাস্তবতারই প্রতিফলন। এটি অস্বীকার করার কারণ নেই। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো পরিবর্তন এসেছে এটা বলা যাবে না। অনুদানপ্রাপ্তির বিষয়টি হয়তো আমাদের জন্য খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু সরকারকে দুর্নীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে মনে করা হয় বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়ে এ বিষয়ে চেপে রাখা হয়েছে। তাই হয়তো নতুন করে তথ্যের স্বাধীনতা রেড তালিকায় গেছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য বড় বাধা।

এ প্রসঙ্গে ইআরডির আমেরিকা ডেস্কের প্রধান যুগ্ম সচিব সুলতানা আফরোজ যুগান্তরকে বলেন, স্কোর উন্নতি করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হতে কাজ শুরু করা হয়েছে। সম্প্রতি স্কোর কার্ডের বিষয়টি নিয়ে ইউএসএআইডির ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। তারা আমাদের বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আগামীতে আরও কীভাবে কাজ করলে সূচকের উন্নতির মাধ্যমে অনুদান পাওয়া সম্ভব হবে সেটি নিয়েও কাজ চলছে। চেষ্টা করছি আগামী অর্থবছরে হয়তো আমরা অনুদান পেতে পারি। লাল তালিকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ইআরডির বিষয় নয়। তাছাড়া আমরাও ভালোভাবে বুঝছি না স্কোর কার্ড কেন এমন হয়েছে।

লাল সূচকগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইআরডির সাবেক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, দুর্নীতির মধ্যে সুশাসনকে ধরা হয় সবার আগে। এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেক্ষেত্রেই কোনো উন্নতি নেই। নিয়ন্ত্রক মানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিটিআরসিসহ সরকারের রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর কাজের মান সন্তোষজনক নয়।

জমি অধিকার ও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, জমি সংক্রান্ত মামলাগুলো আদালতে দীর্ঘদিন বিচারাধীন অবস্থায় ঝুলে থাকে। বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হয় না। এছাড়া ব্যাংক ঋণ পেতে কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। সুদের হার এখনও অনেক বেশি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৪-৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে এখনও ১ শতাংশের নিচে। প্রাথমিক শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের সামান্য উপরে। দেশের নদীগুলো দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে। মৎস্য সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বনজ সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। এসব নানা কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার বিষয়টি লাল তালিকায় রাখা হয়েছে।

তথ্যের স্বাধীনতা ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার বিষয়টি লাল তালিকায় থাকা প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, সম্প্রতি ফ্রিডম হাউসের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবনতি ঘটেছে। শুধু এমসিসিই নয়, সবারই ধারণা তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ জারি করা হচ্ছে। এতে মানুষের স্বাধীনতা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। কিন্তু সরকার এসব বিষয়ে কোনো দৃষ্টি দিচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে ৮টি নতুন নির্দেশকসহ মোট ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। ওই বছরই সর্বশেষ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধিরা। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে।

ইআরডি সূত্র জানায়, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এমসিএফের আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অংকের সহায়তার দেশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অংকের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অংকের অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। এই ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতিবছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)।

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button