মুক্তমত

ঐশীর যাবজ্জীবন : চলুন একটু ভেবে দেখি

ঢাকা, ০৭ জুন, (ডেইলি টাইমস ২৪):

বাবা মা’কে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় হয়েছিল ঐশীর। উচ্চ আদালতে আপিল করে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কন্যা সন্তানের হাতে বাবা-মা দু’জনেরই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিক সময়ের এক বিস্ময়কর ঘটনা।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি)পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান তাদের দুই সন্তান; মেয়ে ঐশী এবং ছেলে ঐহীকে নিয়ে ঢাকায় চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি বাবা মেয়েকে হাত খরচের জন্য দৈনিক প্রচুর টাকা-পয়সা দিতেন। মেয়ে ক্রমশ ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। রাত করে বাসায় ফিরতে থাকে। এই নিয়ে ঐশীর সাথে মনোমালিন্য হয়। এক পর্যায়ে ঐশীর বাবা-মা তার বাইরে যাবার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। ক্ষিপ্ত হয়ে ঐশী তার বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় নিজ হাতে নৃশংসভাবে কুপিয়ে তার বাবা-মাকে খুন করে।

ঐশী আদালতকে জানায়, “আমার মা ছিল আমার দুই চোখের বিষ। সব সময় আমাকে গালিগালাজ করতো। আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতো। এক সময় আমি পরিবারে একা হয়ে যাই। ছোটভাই ঐহীকে ছাড়া কাউকেই আমার সহ্য হত না।”

এই হচ্ছে স্টোরি লাইন। এই ঘটনা আমাদের কি শিক্ষা দেয়? কি আমরা শিখলাম? কেন এমন ঐশী আমাদের তৈরি হলো? চলুন, বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি। আমাদের ভোগবাদী সমাজিক পরিকাঠামোর অন্তরালে আমরা কোথায় ক্ষয়ে যাচ্ছি, চলুন আমরা একটুখানি ভাবি। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক কেমন আছে আর কেমন হওয়া উচিত, চলুন সেটা নিয়ে ভাবি? সন্তানকে কি ভাবে কতটুকু সময় এবং অর্থ দেয়া উচিত সেগুলো নিয়ে ভাবি। পরিবারে মা ও বাবা’র দু’জনেরই ভূমিকা নিয়ে ভাবি।

আমরা আমাদের সন্তানদের কিভাবে মানুষ করছি? মেয়েকে শাসন করলেই সেকি তার বাবা-মাকে খুন করার কথা ভাববে? কখন ভাববে? কী ধরনের বন্ধু-বান্ধবের সাথে আপনার আমার সন্তানেরা মিশছে? তারাও তো অন্য কোন বাবা-মায়ের সন্তান। আমরা বয়োসন্ধিকালীন সময়ে সন্তানদের সাথে কি ভাবে আচরণ করবো? শিশু সন্তানদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হতে হবে? এইগুলো নিয়ে তো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই। নেই কোন স্টাডি সার্কেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের বাবা-মা আমাদের প্রতি যে আচরণ করেছে তাকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে থাকি। সময়, পরিস্থিতি, পারিপার্শিক খুব বেশি বিবেচনায় রাখি না। প্রাইভেসির নামে একই বাসায় দুই তিনটা টিভিতে পৃথক পৃথক কক্ষে অরুচিকর হিন্দি, বাংলা আর ইংরেজি সিরিয়াল দিনের পর দিন গিলতে থাকি।

পরিবারের ডিসিপ্লিন বলে কিছু মানি না। সন্তানরা দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠলে সেটাকে আধুনিক লাইফস্টাইল বলে মেনে নেই। তিনবেলার মধ্যে এক বেলাও একসাথে বসে আহার করি না। বাসায় কোন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই পত্র কিছুই রাখি না। সন্তানদের কখনো বই কিনে দেই না। তাদের কখনো গরিব-দুঃখীদের সাথে মিশতে দেই না। তাদের জীবনকে দেখতে দেই না। তাদের গ্রামে নিয়ে যাই না। মোদ্দা কথা হলো জীবন বিচ্ছিন্ন এক ফ্যান্টাসির জগতের মধ্য দিয়ে তাদের আমরা বড়ো করে তুলি। তারপর তারা যখন এক সময় অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে এবং আমরা রাতারাতি তাকে পরিবর্তন করার জন্য মরিয়া হয়ে রূঢ় আচরণ করি। যার ফল তখন হয় ভয়াবহ। ঐশী সেই প্রক্রিয়ারই ফল। আমরাই ঐশীদের তৈরি করি। চলুন, আমরা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি এবং পরিবারগুলোকে রক্ষা করি। একটি উন্নত সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে হলে যত্ন করে পরিবারগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। একটি সুস্থ, সুন্দর পরিবারের চেয়ে বড় আশীর্বাদ মানুষের জীবনে আর তো কিছু নেই।

লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button