
পাহাড়ে ভূমিধস : বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
ঢাকা, ১৪ জুন, (ডেইলি টাইমস ২৪):
সময়টা ২০১২ সালের জুন মাস। কাজ করি রেড ক্রিসেন্টের সাথে। আইলা পুনর্বাসন প্রকল্পের একটা ফিল্ড ছিলো খুলনার দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়নে। কাঠফাটা গরমের আর নোনাপানির জ্বালা ধরা বাতাসের মাঝে ৪ দিন কেটে যাওয়ার পর পঞ্চম দিনে নামলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সাগরে তিন নম্বর সিগন্যাল আর নিম্নচাপের ভয়। বৃষ্টির কারণে ফিল্ডের কাজ বন্ধ। টিভি দেখে সময় কাটাচ্ছিলাম।
খবরের চ্যানেলগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে খবর পেলাম প্রবল বর্ষণে পুরো চট্টগ্রাম শহর ডুবে গেছে। আর হয়েছে পাহাড়ধ্স- চট্টগ্রাম শহরে, কক্সবাজারে, মহেশখালীতে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বান্দরবানের লামায়, নাইক্ষংছড়ি আর সদর উপজেলায়। ঠিক সংখ্যাটা মনে পড়ছে না- তবে যতদূর মনে পড়ে প্রায় ২৫০ লোক মারা গেছিলো মাটি চাপা পড়ে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে রেড ক্রিসেন্ট একটা ফান্ড পেয়েছে ওই আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য। উপকারভোগী নির্বাচনে গেলাম লামায়। ঘটনার ৬ মাস পরে ভয়াবহতার ছিটেফোটাও থাকার কথা না, আমার হিসেব মতে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম ঘটনার ভয়াবহতা ছয়মাস পরেও কাটেনি। ওইদিনও আজকের মতো দেখা গেছিলো পাহাড়ীদের তুলনায় বাঙালিদের ঘরবাড়ি ভেঙেছিলো বেশি। মারাও পড়েছিলো বাঙালিরা বেশি। এর কারণটা বহুবিধ! সে দিকেই যাচ্ছি।
পাহাড়ীরা যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওই এলাকায় বাস করে আসছে। তারা ঠেকে পড়ে শিখেছে, দাদার মুখ থেকে শুনেছে কিভাবে ঘরবাড়ি বানাতে হবে- কোন প্যাটার্নের ঘর কোথায় বানালে তাদের জন্য নিরাপদ হবে বেশি- তা ওরা জানে অনেকদিন ধরে। এটাকেই বলে “ইন্ডিজেনাস নলেজ” । অন্যদিকে আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা, ওখানে আছেনই মাত্র কয়েক দশক ধরে, সমতল থেকে গিয়ে পাহাড়ে আবাস করা এই মানুষজনের না আছে এই ব্যাপারে অভিজ্ঞতাপ্রসূত কোন জ্ঞান, না আছে ঘরবাড়ি বানানোর কোন চলনসই কৌশল।
সমতলের মানুষরা যেভাবে, যে ধরনের বাড়ি ঘরে বসবাসে অভ্যস্ত ওখানেও তাড়া এমনতর ঘরই বানিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়। তাছাড়া একদম খাড়া পাহাড়ের নিচে বাড়ি বানানো, অবলীলায় পাহাড় কেটে ফেলা। এসব কিছুই ভূমিধসে তাদেরকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলে- যার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের খুব সামনেই। গতকালের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন। এর থেকে বাঁচার উপায় কী? হ্যাঁ আপনি হয়তো বলতে পারেন, বৃষ্টির পূর্বাভাস পেলে এই মানুষজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হবে, করা হবে স্থানান্তর। সাময়িক উপশম হবে হয়তো, কিন্তু এটা কিন্তু কোন স্থায়ী সমাধান না। টেকসই উন্নয়নের এই যুগে এই রকম সমাধান কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না।
আসলে এর কোন সহজ সমাধান নাই। আন্তর্জাতিক রেডক্রসসহ আরো কয়েকটি সংস্থার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়িঘর বানানোর ব্যাপারে লোকদের সতর্ক করার ব্যাপারে একটা অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যার নাম “Participatory Approach of Safe Shelter Awareness” সংক্ষেপে “পাশা” । যেখানে কমিউনিটির লোকজনকে সাথে নিয়ে প্রশিক্ষিত সহায়কদের মাধ্যমে জনগণের মাধ্যমে তাদের সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী সমর্থ ঘর বানানোর উপায় বের করা ও তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এটা কাজ করেছে। এমনকি আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কিংবা উত্তরবঙ্গের বন্যা দুর্গত এলাকায়ও কাজ করেছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো উদ্যোগী হলে লোকজনকে সতর্ক করার জন্য এমন কিছু পদ্ধতির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। প্রচলন করা যেতে পারে পাহাড় আবাসন কর্তৃপক্ষের, হতে পারে পৃথক একটি আবাসন আইন। অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে ?