জাতীয়

রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত

ঢাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর,(ডেইলি টাইমস ২৪):

রোহিঙ্গা ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করেছে ভারত। প্রতিবেশী এ দেশটি এখন রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকবে। দিল্লির এ বার্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। দু’দিন আগে টেলিফোনেই কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। এবার দু’জন একই ফ্লাইটে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময়ে সেই আলোচনাই হয়েছে।

দিল্লির বরফ গলাতে নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তবে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিও ভারতের ইউটার্ন নেয়ার পেছনে কাজ করেছে। ঢাকা, নিউইয়র্ক, আবুধাবি ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র একথা নিশ্চিত করেছে। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের সঙ্গে একই সুরে রোহিঙ্গা সংকটকে একটি ‘ইসলামী সন্ত্রাসী ইস্যু’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এখন তার অবস্থানের বড় পরিবর্তন হল।

দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় বাংলাদেশ বেশ বিলম্ব করেছে। মোদি মিয়ানমার সফরে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের কোনো দূতকে পাঠিয়ে বাংলাদেশের সমর্থন কামনা করা হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সুচির সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি ভিন্নভাবে তুলতে পারতেন। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ উদ্যোগ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বৃহস্পতিবার রাতে টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লির অবস্থান পরিবর্তনের কথা জানান।

ঢাকার একজন কূটনীতিক যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সুষমা টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে জানান যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানেই বিশ্বাস করে ভারত। ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বলবে ভারত। এছাড়াও, বহুপক্ষীয় এবং গোপনীয় বৈঠকেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা বলবে ভারত। এমন কথাই সুষমা স্বরাজ টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে জানান।

এরপর নিউইয়র্ক সফরকালে শেখ হাসিনা ও সুষমা স্বরাজের একই ফ্লাইটে যাওয়ার বিষয়ে কাজ শুরু করেন ঢাকা ও দিল্লির কর্মকর্তারা। তারা আবুধাবি থেকে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের একই ফ্লাইটে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জার্নি করে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রথমেই নামেন সুষমা স্বরাজ। তারপর বিমান থেকে শেখ হাসিনাকে বেরিয়ে আসতে দেখে সবাই নিশ্চিত হন যে, বিমানে তাদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

একাধিক কূটনৈতিক সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করে যে, তাদের মধ্যে আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সুষমা স্বরাজ। এ বিষয়ে দু’দেশের করণীয় নানা দিক নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এর আগে আবুধাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ কিছু সময় একান্তে কাটিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সেখানে তাদের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। আবুধাবির একটি কূটনৈতিক সূত্র সোমবার যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী আবুধাবিতে ১৭ ঘণ্টা ছিলেন। তিনি সাগ্রিলা হোটেলে অবস্থান করেন। প্রধানমন্ত্রী আবুধাবি থেকে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ইতিহাদ এয়ারওয়েজে রওনা হন। সুষমা স্বরাজ একই ফ্লাইটে আসেন। তারা নিউইয়র্কে পৌঁছান স্থানীয় সময় রোববার বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে। আবুধাবির স্থানীয় সূত্র বলছে, আবুধাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কর্মসূচি ছিল না। শেখ হাসিনার সঙ্গে ওই দেশের সরকারের কারও কোনো কথা হয়নি। আবুধাবিতে শেখ হাসিনাকে স্বাগত ও বিদায় জানান সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপিতো সফরে গিয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত মিয়ানমারের পাশেই থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন। এ বৈঠকের পর ঢাকার টনক নড়ে। ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। পরিস্থিতি ব্রিফ করার জন্য শ্রিংলা দিল্লি যান। তিনি দিল্লি গিয়ে সাউথ ব্লকে পররাষ্ট্র দফতর এবং নর্থ ব্লকে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পরিস্থিতি অবহিত করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মুখ্য সচিব, প্রেস সচিব, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব, যুগ্ম সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন ভারতীয় হাইকমিশনার। শ্রিংলা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সংকটের সময়ে ভারতের উচিত বাংলাদেশের পাশে থাকা। পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক আলাদাভাবে টেলিফোনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেন।

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীও পৃথকভাবে ভারতের সাউথ ব্লক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমর্থন কামনা করেন। তার ফলে ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রাভিশ কুমার একটি বিবৃতি দিয়ে রাখাইন রাজ্যে বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সংযত আচরণ করার জন্যে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান। তবে শ্রিংলার প্রচেষ্টাই দিল্লির অবস্থান বদলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। শ্রিংলা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের জন্যে ত্রাণের ব্যবস্থা করেন। ভারতের ত্রাণসামগ্রীর দুটি চালান ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিউইয়র্কে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে স্বাগত জানান জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বিমানবন্দরের সামনে স্লোগান দেন। আর প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান বিএনপি নেতাকর্মীরা। এদিকে নিউইয়র্কে সুষমা স্বরাজকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবর উদ্দিন। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী মিশনের ওয়েবসাইটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নিউইয়র্ক আগমনের যে ছবি দেয়া হয়েছে সেখানেও স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিন ও স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনকে দেখা যায়।

জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২১ সেপ্টেম্বর ভাষণ দেবেন। এ ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে গুরুত্বারোপ করবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলবেন।

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গীদের বেশিরভাগই এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ঢাকা ছাড়েন। তারা দুবাই হয়ে নিউইয়র্ক যান। তারা স্থানীয় সময় রোববার সোয়া ২টায় নিউইয়র্কে পৌঁছান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবুধাবির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে।

ভূ-রাজনৈতিক কারণ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বদলকে ঢাকার কূটনৈতিক চাপ এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণ বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সাউথ এশিয়ান মনিটর নামের একটি মিডিয়ার রিপোর্টের শিরোনাম হল- ‘জিয়ো-পলিটিক্স বিহাইন্ড ইন্ডিয়াস ইউটার্ন অন রোহিঙ্গাস’। এতে বলা হয়, যদিও ভারতের নীতির পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক কারণ হল ঢাকার কূটনৈতিক চাপ; তবে তার গভীরেও কারণ রয়েছে।

চীন মিয়ানমারকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় ভারত তার কৌশলগত সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রত্যেক দেশের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সুচির ওপর চাপ দিচ্ছিল রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করার জন্য। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ভারতের পরিকল্পনার সমালোচনা করেছেন। একপর্যায়ে ভারতকে তার নীতি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ভারতকে তার নিজের স্বার্থ বিবেচনায় ঠাণ্ডা মাথায় অবস্থান নিতে হল। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ না করলে এবং তাদের ফিরিয়ে না নিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করবে। তার প্রভাব ভারতের ওপরও পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়লে সাধারণ বাংলাদেশিরা ভারতকেই তার জন্য দায়ী করবেন। এটা ভারতবান্ধব শেখ হাসিনা সরকারের ওপর আগামী সংসদ নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button