
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ১৯৯২ সালের সমঝোতা বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ঢাকা, ০৯ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):
বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ১৯৯২ সালের সমঝোতা বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। একইসঙ্গে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানান তিনি।
সোমবার (৯ অক্টোবর) বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারসহ ২৮ দেশের কূটনীতিকদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি অবহিত করার সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একথা বলেন। এ ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্যাতন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে একাধিক কূটনীতিক ব্রিফিং হলেও এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারকে এ ধরনের ব্রিফিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে রাখাইনে নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি এবং সেখান থেকে রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাখাইনে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ওপর এখনও নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেখানে এখনও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কূটনীতিকদের সামনে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি জানান, গত ১০ দিনেও ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। আর ২৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ২০ হাজারে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ ভয়-ভীতি ইত্যাদি কারণে দেশটি থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এসব রোহিঙ্গা।
গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অফিসের ইউনিয়ন মন্ত্রী টিন্ট সোয়ের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা তাকে জানিয়েছি বাংলাদেশে ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আছে এবং আমরা চাই সবাই যেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফেরত যায়।
মন্ত্রী কূটনীতিকদের জানান, আমরা গত মে মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি নন-পেপার দিয়েছিলাম এবং ২৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে সেটিকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে সেপ্টেম্বরে আরেকটি নন-পেপার মিয়ানমারকে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, মিয়ানমারের মন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে যারা তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে তাদের প্রত্যাবাসনে তারা রাজি। ভেরিফিকেশনের জন্য তারা ১৯৯২ সালে গৃহীত যৌথ বিবৃতিকে ভিত্তি হিসাবে ধরার প্রস্তাব করে।
এর জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের বেশিরভাগেরই বাড়িঘর পুড়ে গেছে এবং প্রায় কারও কাছেই কোনও কাগজপত্র নেই। এছাড়া মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিজেই বলেছে অর্ধেক রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, আমরা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন চ্যলেঞ্জের কারণে ১৯৯২ সালের সমঝোতা অনুযায়ী প্রত্যাবাসন বর্তমানে বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি কূটনীতিকদের বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গাদের কাছে কোনও কাগজ নেই, তাই আমরা চাই কোনও রোহিঙ্গা যদি তাদের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারে, ভেরিফিকেশন করার জন্য সেটাই মানদণ্ড হওয়া উচিৎ। এছাড়া এক্ষেত্রে যৌথ ভেরিফিকেশন এবং সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য নেওয়ার কথা বলেছি।
এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একটি নতুন একটি সমঝোতার প্রয়োজন এবং তার একটি খসড়া মিয়ানমারের মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে বলেও কূটনীতিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সুত্র জানায়, তিনি কূটনীতিকদের বলেন, নতুন সমঝোতায় বলা হয়েছে ১৯৭৮-৭৯ এবং ১৯৯২-৯৩ সালের সমঝোতাকে রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া যৌথ ভেরিফিকেশন, সব রোহিঙ্গাদের ফেরত, ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের বসতবাড়িতে ফেরত যেতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া ও তাদেরকে ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড ক্যাম্পে স্থানান্তর না করা, এবং তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের ক্রিমিনাল চার্জ না আনার কথা নতুন সমঝোতায় বলা হয়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নেওয়া এবং কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও পূর্ণ বাস্তবায়নের বিষয়ে নতুন সমঝোতায় জোর দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা দুইপক্ষ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছি কিন্তু বর্তমানে যেটি জরুরি ভিত্তিতে দরকার সেটি হচ্ছে আমাদের সমঝোতা প্রস্তাব সম্পর্কে মিয়ানমারের উত্তর।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর নীতি ও কিভাবে তাদের ফেরত পাঠানো হবে সেটি নির্ধারণ করা সবার আগে দরকার এবং এরপর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অফ রেফারেন্স এবং কারা এ গ্রুপে থাকবে সেটি ঠিক করা যাবে বলে মন্ত্রী কূটনীতিকদের জানান।
তিনি এই সামগ্রিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা কামনা করে বলেন, আমরা আশা করি এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনারা চাপ বজায় রাখবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ব্রিফিংয়ে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া এবং অস্থায়ী সদস্য মিশর, ইটালি, সুইডেন ও জাপানের রাষ্ট্রদূত বা জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা অংশ নেন। এছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, স্পেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত বা জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা এবং আসিয়ান থেকে মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেই এর রাষ্ট্রদূতরা ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য দেশের মধ্যে ভ্যাটিক্যান, ভারত, নরওয়ে, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত কিংবা জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।