সাক্ষাৎকার

বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে: দিলারা জামান

ঢাকা, ১২ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):

দিলারা জামান, অভিনয় দিয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেছেন অনেক আগে। দেশের বর্ষীয়াণ অভিনয়শিল্পীদের মধ্যেও অন্যতম একজন তিনি। পাঁচ দশকের অভিনয়ের ক্যারিয়ার তার। ১৯৬৬ সালে ‘ত্রিধরা’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। এরপর অসংখ্য টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। সেটি ২০০৮ সালে ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করার জন্য।

সম্প্রতি প্রিয়.কম অফিসে এসেছিলেন অভিনত্রী। কথা বলেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। আর সে সময় তাকে দেখে তাঁর কাছে গেলেন অফিসের বেশ কয়েকজন সহকর্মী। সে সময়কার অফিসের আবহে তিনি মনে মনে যে খুশি হয়েছেন তা বোঝা গেলেও তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেছো, সবকয়টা ফাঁকিবাজ, কাজ বাদ দিয়ে উঠে এসেছে!’ এরপর তিনি অভিনেত্রী হিসেবে নন, একজন মমতাময়ী মায়ের মতো সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে, গলা জড়িয়ে ছবি তুললেন। এরপরেই শুরু হলো সাক্ষাৎকার পর্ব।

এক জীবনে ৭০টিরও বেশি শরৎ পার করলেন, (৭৫ বছর বয়সে পা দিয়েছেন) জীবন নিয়ে এই সময়ের ভাবনাগুলো ঠিক কেমন, কিংবা সময়গুলো আপনার জীবনবোধকে কীভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়?

দিলারা জামান: আমার জীবনের এখনকার ভাবনাগুলো আমাকে খুব তাড়িত করে। এই অর্থে-এটা কেন এমন হলো, এটা তো না হলেও পারত, কোন অনিয়মের প্রতিবাদ আমি যদি আগ বাড়িয়ে করতে পারতাম তাহলে সবার জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকতে পারত, কিন্তু কেন সেই কাজটা করতে পারি না! ঠিক তাৎক্ষণিক যে কাজটা করার, সেটা যদি না করতে পারি সেটা এখন আমাকে বেশি পীড়া দেয়। এবং কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমি বুঝি এখন আমার দ্বারা সব কাজ করা সম্ভব না। বয়স আমাকে সেটা করতে দেয় না। তারপরও কেন জানি একটা অপরাধবোধ আমাকে সব সময় কষ্ট দেয়। আমার মনে হয়, কেন আমি আরও সাহসী হলাম না। কেন আমি অন্যায়গুলোকে মেনে নীরবে চলে আসলাম।

বয়স তো কম হল না, অনেক কিছুরই পালাবদল দেখেছেন। সেসব থেকে শিখেছেনও। আর পাঁচ দশক ধরে অভিনয় করছেন, তারও আগে শিক্ষকতা করেছেন। এখন এসব নিয়ে আপনার উপলব্ধি ঠিক কেমন?

দিলারা জামান: তবে যখন আমার যে দায়িত্ব ছিল, কিংবা আমি যখন যে কাজ করেছি, সেটা ঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। একসময় প্রফেশন শিক্ষকতা ছিল, আর এখন আমার অভিনয়জীবন ও অভিনয় আমার পেশা। সবখানেই আমি সৎ থাকতে চেষ্টা করেছি। যতটুকু কাজ করেছি আমি সে কাজে একনিষ্ট ছিলাম। এবং কখনও সেটা অর্ধসমাপ্ত কিংবা না করে সেটি থেকে ফায়দা লুটা বা নিজের স্বার্থ দেখার কখনই চেষ্টা করিনি। এই তৃপ্তিটুকু আমার মধ্যে আছে। যার কারণে এখনও আমি সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারি।

আমি খুব সাধারণ জীবনযাপন করি। আমার বাসায় দামি কিছু নেই। এজন্য আমার আত্মীয় স্বজন অনেকেই অনেক অভিযোগ করেন। আমি তাদের বলি, দেখাবার কিছু নেই। আমার কর্মই সব। সেখান থেকে মানুষ যদি কিছু শিখতে পারে, সেখানেই আমার স্বার্থকতা। তবে আমি মনে করি, হয়তো একজীবনে আমি তেমন কিছু করতে পারিনি। যতটুকু করেছি আমার মনে হয়, সেটা আমি সঠিকভাবে না হলেও যথাযথভাবে করার চেষ্টা করেছি। কাউকে কখনও বঞ্চিত করিনি, আঘাত দিইনি। নিজের স্বার্থের উর্ধ্বে সে কাজটা করার চেষ্টা করেছি।

নিত্য নতুন চরিত্রের জন্য ভাবতে হয়, নিজেকে তৈরিও করতে হয়। এরপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সঠিকভাবে ডেলিভারি দিতে হয়, যার জন্য মানসিক শক্তিরও দরকার হয়। আর এখনও কাজের জন্য এ ধরনের অনুপ্রেরণাটা কোথা থেকে পান?

দিলারা জামান: আমি শুরুতেই বলেছি, আমি কাজের ব্যাপারে সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। আমি অভিনয় পেশায় যেমন সৎ থাকার চেষ্টা করেছি, আমি যখন শিক্ষকতা করতাম, তখন একজন ছাত্রকে যতটুকু সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমি সাধ্যমত করার চেষ্টা করেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পড়া আদায় করতে পেরেছি। কিন্তু আমি যখন অভিনয়টাকে পেশা হিসেবে নিলাম তখন শুধু পেশা নয়, এক ধরনের দায়িত্ববোধও চলে এসেছে। এই যে নাটকের চরিত্রগুলো তা আমার সন্তানের মতো।

আমার সন্তানদের ভালো থাকার জন্য যেটা সব থেকে ভালো সেটা দেওয়ার সব সময় চেষ্টা করতাম। সেটাও আমার মাথায় ছিল। কেউ যদি আমার বাসায় যায়, দেখে স্ক্রিপ্টগুলো আমার বিছানায় মাথার কাছে থাকে। আমার মনে হয়, আমার চরিত্রটাকে কীভাবে ধারণ করব, উপস্থাপনা করব সেটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হবে, সব বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমি চরিত্রটি ধারণ করার চেষ্টা করি। আমি জানি না, কতটুকু করতে পারি। আর সে সময়টুকু আবার সব সময় পাওয়াও যায় না। রুদ্ধশ্বাস গতিতে ছুটে চলা, আগে যেভাবে যথেষ্ট সময় পাওয়া যেত একটি চরিত্র বোঝার জন্য, এখন আর সে সময়টা পাওয়া যায় না। তারপরও আমি এখন বেশি কাজ করি না।

যেগুলো করি সে কাজগুলোর চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি বলেই করি। এখন অনেকেই বলেন, শুটিংয়ে গেলে স্ক্রিপ্ট বলে দেওয়া হবে, কিংবা সেখানে দেওয়া হবে। এখন বলতে গেলে বোধহয় আমি পরাজিতই, অনেকক্ষেত্রে সেটা গ্রহণ করি। কিছুদিন আগেও সেটা আমি গ্রহণ করতাম না। এখন জীবন আমাকে যেভাবে তাড়িত করছে, বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়েই মাঝেমধ্যে করে ফেলি গ্রহণ। তারপর আবার নিজের মনোকষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে ভুগি। কেন করলাম? আমার করা উচিত হয়নি। এইভাবেই চলছে আর কি! একটা কম্প্রোমাইজের বিষয় রয়েছে। শেষ বয়স তো, কম্প্রোমাইজ তো বেঁচে থাকার তাগিদে করছি। কারণ বেঁচে থাকার জন্য অর্থ-কড়িটাই এখন বড় ব্যাপার। শুধু খাওয়া নয়, এর সঙ্গে চিকিৎসা ও আরও অনেক ব্যাপার আছে। বিষয়টা হল মানিয়ে চলতে হয় আর কি! জীবনটাই তো কম্প্রোমাইজের ব্যাপার।

এই যে সময় ও বয়সের কথা বললেন, আপনার বড় মেয়ে ডাক্তার তানিরা আমেরিকায় থাকে। ছোট মেয়ে যোবায়রা কানাডায় রয়েছে। পেশায় যোবায়রা আইনজীবী। আপনার সন্তানেরা এখন ঠিক কেমন সাপোর্ট করছেন আপনাকে?

দিলারা জামান: তারা তো খুবই মনঃক্ষুণ্ণ। ওরা বলে, কী দরকার এখনও রাত দশটা, এগারটা পর্যন্ত কাজ করার? আমি বলি যে দেখো, আমি কাজ করে যে পয়সাটা পাই, সেটা ঠিক ভরণ পোষনের জন্য, বিষয়টা কিন্তু ঠিক তা নয়। একটা মানসিক তৃপ্তি আছে। সে সঙ্গে আমার এই পয়সাটা কিছু মানুষকে সাহায্য করি। তারা তাদের পড়াশোনার খরচ চালায়। কিংবা তাদের প্রয়োজনে খরচ করে।

এ কথাটা আমি কখনও কাউকে বলি না। তবে আজ বললাম। যখন দিই আমি খুব একটা তৃপ্তি পাই। আমার আনন্দ লাগে। কিছু একটা করতে পারলাম। এই অভিনয়টাকেই ভালোবেসেছি। আমি যখন কাজ শুরু করেছি, সে সময় শুধু অভিনয় করে কেউ জীবন-জীবিকা ধারণ করতে পারত না। যদিও এখন সে পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে গেছে। শুরুতে এ পেশায় আসার পর আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে এখন আমি পুরোপুরি স্বাধীন। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলি না।

আপনি এখন যে ধরণ কিংবা যে মাপের চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে চান, সেরকমই কী পান, নাকি হেরফের থাকে?

দিলারা জামান: আগে যে নাটকগুলো হত, তাতে একটা গল্প থাকত, অনেক সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে যিনি নাট্যকার থাকতেন তিনি কাজটি করতেন। এখন সময় বদলে গেছে, মানুষের রুচি বদলে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে অন্যায় করা হবে। জীবন এতো দ্রুত গতিতে বদলে গেছে কিংবা এগিয়ে যাচ্ছে, একটা চরিত্র নিয়ে সেটার ডেভলপমেন্ট কতখানি হবে, অন্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা- এসবকিছু কিন্তু কেউ এখন চিন্তাও করে না। যারা করেন তাদের সংখ্যা খুবই কম।

সেজন্য আমি খুব হতাশ না। আমরা খুবই একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো আবার ঠিক হবে। তবে আগের মত চিন্তা করলে, আগের একটি নাটক দেখার জন্য বাসার ড্রয়িং রুমে জায়গা পাওয়া যেত না। বাড়ির সবাই মিলে নাটক দেখত। এখন সেটা না। আমি তো অনেক সময় ঠাট্টা করে বলি- দুটি চরিত্র, একটি ছেলে, একটি মেয়ে ও দুটি মোবাইল হলে একটি নাটক হয়ে যায়। এর কিছু দর্শক আছে। আর দর্শক তো বিভিন্ন শ্রেণীর। সবার চিন্তা ও রুচির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এটা একটা সময় যাচ্ছে, এটা ঠিক হয়ে যাবে।

পৃথিবীর অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অনেক উদাহরণ আছে, শুধু সিনিয়র আর্টিষ্ট ভিত্তিক গল্পের চিত্রনাট্য সাজানো হয়, এমন কী সে কাজগুলো ভীষণ জনপ্রিয় হয়, কিন্তু আমাদের এখানে সে ধরনের চর্চার জায়গাটা ভীষণ দুর্বল কেন?

দিলারা জামান: বর্তমানে এমন একটা সময় যাচ্ছে, যাকে আমি মাঝে মাঝে অসুস্থ বলি। এই কারণে বলি, সবাই সুড়সুড়ি দিয়ে জোর করে হাসানোর একটা চেষ্টা করি। যেগুলো আবার আমাদের জীবনের সঙ্গে যায় না। অদ্ভূত ধরনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ে নাটক তৈরি হচ্ছে। এবং কিছু মানুষকে আগে যেমন ছোট বেলায় দেখতাম, কোন ব্যথা উঠলে কোন মানুষকে আফিম খাইয়ে দেওয়া হত। এইটুকু সময় আচ্ছন্ন করে রাখা। যেটা আমাদের জীবনের সঙ্গে, পারিপাশ্বিক বিষয়গুলোর সঙ্গে কোথাও সেই চরিত্রগুলোর মিল নেই। তবুও একটু সময় যেন আমরা কষ্ট, দু:খ, যন্ত্রণা থেকে ওইটুকু দেখে ভুলে থাকি। এটা ঠিক নয়। আমাদের রুচি, সবকিছু বদলে দেওয়ার অভ্যাস করাটা ঠিক নয়।

অন্য প্রসঙ্গ, আপনার ৫০ বছরের জীবনসঙ্গী আপনাকে রেখে দূরের নীল আকাশে ঘর বেঁধেছেন। অন্যদিকে কিন্তু আপনি ঢাকাতে একাই থাকছেন। আপনি কেন ভিনদেশে মেয়েদের সঙ্গে পাড়ি জমালেন না?

দিলারা জামান: আমার জীবনসঙ্গীকে নিয়েও অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। অসুস্থ ছিলেন চার বছর। আমাদের বাসায় তিনি যে রুমটাতে থাকতেন, তাকে সেখানে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হত। তিনি ধূমপান করতেন, চিকিৎসক তাকে বারণ করেছিলেন, তিনি সেটা মানেননি। যার কারণে এ অবস্থা হয়েছিল। যারা ধূমপান করেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলব, এটা যারা করেন তারা ছেড়ে দেন। অনেকেই অনেক অসময়ে চলে গেছেন এ কারণে। অনেক কষ্ট পেতে পেতে তিনি মারা গেছেন।

আমার মেয়েরা বলে- তুমি পাগল, কাঁদা মাটি ওয়ালা রাস্তাটা, পিঠ দিয়ে দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে সেই সেই রিকশাওয়ালাটা পিঠটা কিংবা আমার এই চিরচেনা শহরটাকে না দেখলে আমার মনে হয়, আমি কি যেন হারিয়ে ফেলেছি! আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন আমি জানালা ধরে কাঁদতাম, এতো কষ্ট। বাংলাদেশে যখন আসি তখন আবার আমার মেয়েদের জন্য কষ্ট লাগে। যখন ওরা ছোট ছিল তখনও তো ওদের সময় দিতে পারিনি।

তখন তো মোবাইল ছিল না। দেখা গেছে দুই দিন কিংবা তিনদিন আমার মেয়ের সঙ্গে আমার কোন কথাই হয় নাই। যখন সকালে চলে গেছি ওরা ঘুমিয়ে ছিল, আবার শুটিং শেষে রাতে যখন ফিরেছি ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ওদের সময় দেওয়া উচিত। আবার ওখানে গেলে আমার মনে কষ্ট হয়।

এই যে বলি আমি প্রায়ই ডিপ্রেশনে ভুগি- ওখানে গেলে দেশের জন্য মায়া লাগে কষ্ট লাগে, এখানে আসলে ওদের জন্য মায়াও কষ্ট লাগে। কিন্তু তারপরও আমার নিজের দেশে আমি স্বাধীন। আমি কষ্ট হলেও থাকব। ওখানে আমার মেডিকেল সেবা ফ্রি, এছাড়া আরও অনেক কিছুই ফ্রি। তবু সে তো আমার দেশ। যা খারাপ আছে, সেটা আমার।

আপনার জীবনসঙ্গী স্বামী ফখরুজ্জামান চৌধুরী আপনাকে ছেড়ে ২০১৪ সালে পরপারে যান। খুব কাছের মানুষটাই এখন আপনার পাশে নেই। তার সঙ্গটা আপনাকে এখন ঠিক কতটা একাকিত্বের মধ্যে রাখে?

দিলারা জামান: শেষ বয়সে সন্তানের চাইতে স্বামীর কাছে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর কাছে স্বামী বেশ কাছের হয়। কষ্টটা বুঝে। আর ছেলে-মেয়ের কাছে সব কথা বলাও যায় না। তিনি একজন খুব স্বপ্নচারী মানুষ ছিলেন, খুব আদর্শবান। কাল কি দিয়ে ভাত খাবেন তা নিয়ে তার কখনও ভাবনা কাজ করত না। আমি তাকে বলতাম খুব আতেল একটা মানুষ (হা হা হা)। যদিও আমি তার সঙ্গে অত কথাবার্তাও বলতাম না। শেষ জীবনে এসে তিনি চলে যাওয়ার পর এই যে শূন্যতা, মনে হয় কে যেন ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি শুটিং থেকে ফিরে আসলে ঠিক কোনার ঘর থেকে বিছানা থেকে মাথাটা সরিয়ে দেখতেন, আমি ফিরেছি কি না! এই কষ্টগুলো, ব্যাপারগুলো তো কাউকে বলতে পারি না, এই যে শূন্যতা, হাহাকার, একাক্বীত্বগুলো বেশি কষ্ট দেয়। তখন ভাবি একটা সময় তার সঙ্গে কত রাগ করেছি, ঝগড়া করেছি কিন্তু কেন করলাম? একটা মানুষ না হয় ছিল স্বপ্ন বিলাশী, স্বপ্নচারী।

আমি মাঝেমাঝে বলতাম, আমার যদি সামর্থ্য থাকত আমি তোমাকে আমার বাড়ির চিলেকোঠায় একটা রুম দিয়ে দিতাম সেখানে তুমি বইসহ যা যা আছে সেখানে রাখবে। আমি আমেরিকায় যাওয়ার আগে দুলাহাজরায় একটি খ্রিষ্টান মিশনারীতে আড়াই হাজার বই দিয়ে দিয়েছি। এভাবেই চলে গেল জীবন। আর যে কয়েকদিন থাকব স্মৃতিচারণ করব। আর স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে তো কাছে নাই। কবির এ কথাটি এখন বারবার মনে হয়।

(একথাগুলো যখন দিলারা জামান বলছিলেন, তখন তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছিল, আর পাশে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছছিলেন। খানিকটা সময়ের জন্য পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠেছিল…)  

আপনার কখনও কী এমনও হয়েছে, জীবনসঙ্গী চলে যাওয়ার পর তাকে ঘিরে শোকাতুর সময়গুলো কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কোন এক কারণে ভাবলেন, তার কথা মনে আপনার জীবনটা স্থবির হয়ে গিয়েছে-সবকিছু ছেড়ে তার কাছে চলে যাওয়ার এক ধরনের আকাঙ্খা কাজ করেছে?

দিলারা জামান: সে তো একটু অন্যরকম স্বপ্নবিলাসি মনের মানুষ ছিল। না, সেরকম কিছু নয়। একাকিত্বটাই এখন বেশি কষ্ট দেয়। তিনি তো খুব পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। আমি যদি তার সাহায্য-সহযোগিতা না পেতাম তাহলে আজ এ জায়গায় আসতে পারতাম না।

শুনেছি, আপনি এবং আপনার স্বামী একটি ছেলেকে প্রতিপালন করতেন, যে তিন বছর বয়স থেকে আপনাদের বাসায় আসতো। দিন যতো গড়াতে লাগলো, তত সে আপনাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে লাগলো। ২০১২ সালে তার বাবা-মা যখন ঢাকায় ফিরে গেলেন, তখন সে পুরোপুরিভাবে তাদের সঙ্গে থাকা শুরু করলো, সে ঘটনাটা শুনতে চাই।

দিলারা জামান: সে আমার সন্তানেরই মত। ওর নাম আশফাক। ও ওর নাম বদলে ফেলেছে এটা নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। আমি খুব রাগ হয়েছিলাম এ কারণে। ও পড়াশোনা করছে। ও শুক্রবারে বাসায় যায়, ওর বাবা আমার জন্য বাজার করে রাখে কারওয়ান বাজার থেকে। ও আমার কাছেই থেকে পড়াশোনা করে। তেজগাঁও কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছে। আর দুটা সেমিস্টার আছে। তারপর শেষ। আমি বলি পড়াশোনা যতটুকু করো না কেন, সহজ এবং ভালো মানুষ হবে এটাই বিষয়। আমিও এটাই চাই।

প্রকৃতির নিয়মেই তো পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের মতো আপনার জীবনের সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটছে, আপনি ঠিক বিষয়গুলো কেমন উপভোগ করছেন?

দিলারা জামান: আমি হতাশ নই, আমার যে কাজগুলোই থাকে সেটা ঠিকভাবে করার চেষ্টা করি। মানুষের কাজে লাগে তেমন কিছু করার চেষ্টা করি। বিষয়গুলো আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। সময়, বয়স- এগুলো তো হিসাবের খাতায় টুকে রাখার জন্য। তবে আমি বিশ্বাস করি যারা তরুণ প্রজন্ম রয়েছে তারা এই দেশটাকে তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আমি বিশ্বাস করি মানুষ যত মাটির কাছাকাছি থাকবে সেটা তার মধ্যে তত প্রভাব বিস্তার করবে। আমরা যারা শিক্ষিত কিংবা রুচিশীল হওয়ার ভান করি তাদেরই যত চাওয়া আর আকাঙ্খা।

কিছুদিন আগে আপনি ভিন্নরূপে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে হাজির হয়ে বেশ আলোচনা সৃষ্টি করেন। লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘আইস টুডে’র আগস্ট সংখ্যায় আপনার ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল? যৌবনের সময়গুলোর কথা এখন মনে পড়লে কেমন লাগে?

দিলারা জামান: আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা কেউ নেই। এই যে আবদুল্লাহ আল মামুনসহ আরও অনেকেই চলে গেছেন। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি এতোকিছু হয়ে যাবে। আমাকে ফোন করে বলল, আপনাদের বয়সের কয়েকজনকে নিয়ে একটা ফটোশুট করব। আমি গিয়েছি। ছবি তোলার পর এতো আলোড়ন হবে, আমি বুঝিনি।

[আইস টুডে’র ফটোশুট নিয়েও আলাপ করলেন তিনি। এর মধ্যে কথা প্রসঙ্গে উঠে এলো মেকআপের কথা। ছবি তোলার আগ মুহূর্তে তিনি জানালেন, তিনি মেকআপ করেননি। শুধু তাই নয়, কিছুটা মন খারাপ করে জানালেন, কিছুদিন আগে তিনি তার প্রিয় একটি লিপস্টিক হারিয়ে ফেলেছেন।]

আপনি তো এখনও বেশ ফ্যাশনেবল, কীভাবে নিজের জীবনযাপন এখনও নিয়ন্ত্রণ করেন?

দিলারা জামান: এখানে আমার একটা কষ্ট আছে, আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। পোশাক, জীবযাপন সবকিছু মিলিয়ে একটা বিষয় আছে। ফ্যাশন আমরা অন্যদের থকে ধারণাটা নেব ঠিকই, যেটা আমাদের মানায়। শাড়িটা একদম হারিয়েই যাচ্ছে। আমি ১৯৫৭ সালে টেষ্ট পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে যে শাড়ি পরা শুরু করেছি, এখনও শাড়ি পরছি। কাজের জন্য, কিংবা স্বাচ্ছন্দের জন্য মেয়েরা অন্যান্য পোশাক পরে সেটা ঠিক আছে। শাড়িটা হারিয়েই যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি কী মধ্যপ্রাচ্যের কোন শহরের রাস্তা দিয়ে পথ চলছি কি না! জীবনে চলতে হলে অতো বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই।

তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-কর্মেরও একটি বিষয় কিন্তু চলে আসে, অভিনয়ের পাশাপাশি ধর্ম-কর্ম কিভাবে মেইনটেইন করেন?

দিলারা জামান: অনেকেই বলেন, বয়স হয়েছে আপনার। এখন ধর্ম-কর্ম করা উচিত। আমি তাদের বলি, অভিনয় আমার পেশা। একজন ডাক্তার কিংবা উকিল হজ করে এসে তার পেশায় ফিরে যাচ্ছে না। আমি তো মানুষকে নির্মল আনন্দ দিচ্ছি। যে কাজটি করছি সেটি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করি। আমি কারও কাছে জবাবদিহি করব না। কি কাজ করছি কিংবা কেন করছি।

অবসরে আপনি কী করেন?

দিলারা জামান: শুটিং না থাকলে সেদিন ঘরের কাজগুলো করি। সেদিন বাজার করা, রান্না করা কিংবা কাউকে দেখতে যাওয়া। সে অসুস্থ, সে কাজগুলো করে ফেলি, টিভি দেখি। খণ্ড নাটকগুলো দেখি। কে কি করছে। কারও কোন ভুল থাকলে সেটা পরের দিন শুটিংয়ে গিয়ে তাদের সে কথাগুলো বলি।

আপনার অভিনয় কেন্দ্রীক ব্যস্ততা এখন ঠিক কেমন?

দিলারা জামান: দুটি ধারাবাহিক নাটকের কাজ করছি। একটা ‘বৃষ্টিদের বাড়ি’। আরেকটি ‘মহাগুরু’, এর পরিচালক কায়সার আহমেদ। আরেকটি এনটিভিতে যাচ্ছে, তুহিন এই নাটকের পরিচালক। আর ছবি করেছি ‘হালদা’ ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। আর ‘বিজলি’ সিনেমাটি মুক্তির অপেক্ষায় আছে।

তথ্যসূত্রঃ প্রিয়.কম 

 

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button