
জাতীয়
খাল-জলাধার ভরাট করে আমিন মোহাম্মদের আবাসন প্রকল্প
ঢাকা, ১২ অক্টোবর, (ডেইলি টাইমস ২৪):
রাজধানীর মাণ্ডা এবং আশপাশের এলাকার খাল, বিল ও জলাধার ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ধ্বংস করে দখলযজ্ঞ চালালেও সেদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো সংস্থার দৃষ্টি নেই। এ সুযোগে তারা ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ফেলেছে। এর ফলে ঢাকার এ অংশে নির্ঘাত মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের এরকম বেআইনি কর্মকাণ্ডের এখানেই শেষ নয়, জাল দলিলপত্র দেখিয়ে ২০১৫ সালে তারা প্রকল্পের এ, বি, সি ও ডি ব্লকের অনুমোদন নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাস্তবতা হল- প্রকল্পের অনুমোদিত জমির বাইরে অবৈধভাবে বিস্তীর্ণ এলাকা ভরাট করে হাজার হাজার প্লট বিক্রি করা হচ্ছে। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনুমোদনহীন প্রকল্পের প্লট কিনে প্রতারিত হচ্ছেন শত শত গ্রাহক। বছরের পর বছর ঘুরেও তারা এসব প্লট বুঝে পাওয়া তো দূরের কথা, বাস্তবে জমির চেহারা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন না। ভুক্তভোগী মহল সূত্রে এ রকম অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে জলাধার ভরাটের বিরুদ্ধে রাজউক উচ্চ আদালতে রিট করে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা পেলেও রহস্যজনক কারণে আজও সে মামলা করেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে প্রশাসন ও প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার সুযোগ পাচ্ছে গ্রীন মডেল টাউন তথা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল টাউনের কোনো অনিয়মের তথ্য আমার জানা নেই। আমি সংশ্লিষ্ট প্রকল্প এলাকায় দ্রুত প্রতিনিধি দল পাঠাব। এরপর তাদের প্রতিবেদনে যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে জানা যায়- ঢাকার পূর্বাংশের মুগদা, মাণ্ডা, দক্ষিণগাঁও, ডেমরা ও মাতুয়াইলের নিচু এলাকা, খাল ও জলাধার ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল টাউন প্রকল্প। মাণ্ডার বেগুনবাড়ি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ওই এলাকার ১০০ ফুট চওড়া প্রায় তিন কিলোমিটার খাল ইতিমধ্যে ভরাট করে ফেলেছে। এ নিয়ে কয়েক দফা এলাকাসীর সঙ্গে সংঘর্ষও হয়। কিন্তু আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের ক্যাডার বাহিনীর কারণে এলাকার সাধারণ মানুষ তা শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন।
দেখা গেছে, প্রকল্পের দক্ষিণ ও পূর্বাংশে এখন বালু ফেলে জলাধার ও নিচু জমি ভরাটযজ্ঞ চলছে। প্রকল্পের একজন নিরাপত্তা কর্মী বলেন, গ্রীন মডেল টাউনের ভেতর দিয়ে খাল প্রবাহিত ছিল। আমরাও সেটা দেখেছি। কিন্তু প্রকল্পের জন্য দীর্ঘ খাল ভরাট করা হয়েছে। বছর দুই আগে রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তা এসে ওই খাল খনন করার জন্য আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের কড়া নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু এরপর তিনি খাল খননের কোনো উদ্যোগ দেখেননি।
এলাকাবাসী জানান, মাণ্ডার বেগুনবাড়ি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত খালটি গ্রীন মডেল টাউনের ভেতরে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে প্রবাহিত ছিল। একটি অংশ প্রকল্পের মাঝখান দিয়ে এবং অপর অংশ প্রকল্পের পূর্ব দিক দিয়ে চলে যায়। এ খালের পানি অন্য খাল ও জলাধারে মিশে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে পড়ত। কিন্তু সবই আজ স্মৃতি। বাস্তবে খালের কোনো চিহ্ন নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতিমধ্যে জাল-জালিয়াতি করে প্রকল্পের এ, বি, সি ও ডি ব্লক গড়ে তোলার পর এখন তারা ক্রমেই সামনে এগোচ্ছে। এখন ভরাটের সীমা প্রকল্পের ই, এফ, জি, এইচ ও আই ব্লক পর্যন্ত গড়িয়েছে। উদ্দেশ্য একেবারে শীতলক্ষ্যার তীরে নিয়ে যাওয়া। এসব ব্লকের কোনো অনুমোদন নেই। অথচ সবই হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। কিন্তু সবাই দেখেও না দেখার ভান করছেন। কারণ সংশ্লিষ্টরা প্রত্যেকে ম্যানেজড। তাই ক্ষতি ও দুর্ভোগ যত সাধারণ মানুষের। এমনটিই বলছেন, বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী আরও জানান, ২০০১ সালে গ্রীন মডেল টাউন প্রকল্পের ভরাট কাজ শুরুর পর ধাপে ধাপে খাল ভরাট করে ফেলা হয়। ওই সময় এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানালে রাজউক ওই খালের অল্প কিছু অংশ কাটতে বাধ্য করে। প্রকল্পের বি-ব্লকের ৫ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর প্লট থেকে খাল বন্ধ। এরপর কোথাও খালের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকল্প অনুমোদনের শর্ত হিসেবে খাল খননের শর্ত দেয় রাজউক। কিন্তু এখনও ওই খাল কাটা শুরু করেনি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। অর্থাৎ কাজীর গরু শুধু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রচারপত্রে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ মাণ্ডার গ্রীন মডেল টাউন প্রকল্পে ৪৮ ভাগ জায়গা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য উন্মুক্ত রাখা আছে বলে দাবি করে আসছে। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন চিত্র। অনেকের প্রশ্ন, যে কোম্পানি খাল, জলাধার ও বিল ভরাট করে প্লট করে বিক্রি করছে, সে কোম্পানি কিভাবে এত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেবে। এটা প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে গুলশান থেকে ওই প্রকল্প মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্ব বলেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গুলশানের যে কোনো স্থান থেকে ওই প্রকল্পে পৌঁছাতে ন্যূনতম এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজউকের করা এক রিট মামলায় রায়ে উচ্চ আদালত রাজউককে জলাধার আইন লঙ্ঘনের দায়ে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল টাউনের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় মামলা করার ক্ষমতা দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রাজউক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। এখানেই সব রহস্য ও প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। কারণ রাজউক নিজের দায়ের করা রিটে মামলা করার ক্ষমতা পেয়েও করেনি। এটি বিস্ময়কর বললেও ভুল বলা হবে।
এ প্রসঙ্গে মাণ্ডার ছাতা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা বাবুল হোসেন বলেন, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল আবাসন প্রকল্পের অনিয়মের শেষ নেই। জলাধার আইন লঙ্ঘন করে খাল, বিল ও জলাধার ভরাট করেছে। সরকারি হালট দখল করে নিজেদের প্রকল্পে সড়ক দেখিয়েছে। এছাড়া টাকা পরিশোধ না করে মানুষের জমিও দখল করে নিয়েছে। এমন শত শত ঘটনা রয়েছে। অন্যদিকে প্লট ক্রেতাদের টাকা নিয়ে বছরের পর বছর ঘোরাচ্ছে, অথচ তা বুঝিয়ে দিচ্ছে না। এদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় এ বাসিন্দা।
বেগুনবাড়ি (দক্ষিণগাঁও) এলাকার বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ হাজী আবদুস সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল টাউন প্রকল্পের ভেতর দিয়ে প্রবহমান খাল ছিল। ওই খালটি দুটি শাখায় বিভক্ত। এক সময় আমিও নৌকা বেয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত যেতাম। তিনি বলেন, নিজের চোখের সামনে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপকে এ খাল ভরাট করতে দেখেছি। বিভিন্ন সময় আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় খাল ভরাট কাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। ফের খাল ভরাট শুরু হয়। কিন্তু রাজউক, ডিসি অফিস ও পরিবেশ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নির্বিকার।
এ প্রসঙ্গে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের গ্রীন মডেল টাউনের ব্যবস্থাপক জামিল হোসেন বলেন, সরকারি নিয়ম মেনে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। কোনো খাল, জলাধার বা বিল ভরাট করে প্রকল্প করা হচ্ছে না। প্রশাসন সবই জানে।
এ প্রসঙ্গে রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব এসেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে তাই অবশ্যই প্রকল্প এলাকায় সার্ভেয়ার পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।