মুক্তমতলিড নিউজ

যুবদলের ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও গৌরবের ৪৪ বছর

এইচ এম সাঈফ আলী খান
১৯৭৮ সালের ২৭ অক্টোবর ‘জীবন বাংলাদেশ আমার মরন বাংলাদেশ’ এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল। উৎপাদনমুখী রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, মানবকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনে প্রত্যেক স্তরে সৎ, মেধাবী ও নিঃস্বার্থ যুবকদের সমন্বয়ে আদর্শবান নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষে জাতীয়তবাদী যুবদলের প্রতিষ্ঠা করেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র পূণরুদ্ধার ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জেল, জুলুম, নির্যাতন ও বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিতে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও গৌরবের ৪৪ বছরে পর্দাপন করেছে জাতীয়তাবাদী যুবদল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে যুবদল। রাজপথে আন্দোলনে বিএনপির ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে খ্যাতি পায় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা যুবদল।
১৯৭৮ সালে আবুল কাসেমকে আহবায়ক করে যুবদলের প্রতিষ্ঠা কালিন আহবায়ক কমিটি করা হয়। পরে ওই বছরই আবুল কাসেমকে সভাপতি ও সাইফুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে শহীদ হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সেই সাথে বাংলাদেশের মানুষ হারায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও ভোটাধিকার।
হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রপূণরুদ্ধে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে আসেন বেগম খালেদা জিয়া, হাল ধরেন বিএনপির। ষড়যন্ত্রেও মাধ্যমে ভুলুষ্ঠিত হওয়া গণতন্ত্র পূণরুদ্ধারে সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৮৭ সালের ২৩ মার্চ যুবদলের দ্বিতীয় কমিটি গঠণ করা হয়। সেখানে সভাপতি হিসেবে মির্জা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নির্বাচিত হন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথ দখল নিয়ে নেয় যুবদলের নেতৃবৃন্দ। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যুবদল, ছাত্রদল, সকল অঙ্গসংগঠনসহ জনসাধারণকে সাথে নিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটিয়ে দেশে আবারও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের জনগণ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে এবং ১৯ শে মার্চ বেগম খালেদা জিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিএনপি সরকার দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রীক পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করেন। গৌরবোজ্জল ভূমিকার জন্য মির্জা আব্বাস ১৯৯১ সালে ঢাকা সিটির মেয়র এবং পরবর্তিতে সরকারের মন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান । ১৯৯৩ সালের ৮ অক্টোবর যুবদলের পরের কমিটি গঠিত হলে গণতন্ত্র পূণরুদ্ধারের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় মির্জা আব্বাস-গয়েশ্বর চন্দ্র রায় পুনরায় যুবদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ লড়াই সংগ্রমের মাধ্যমে দেশে গনতন্ত্র পূণরুদ্ধের পর দেশ গড়ার দিকে মনোনিবেশ করেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের নেতাকর্মীগন। দেশের অসহায়, হত দরিদ্র ও বন্যা-ঘুর্ণীঝড়ে আক্রান্তদের পাশে সহায়তা ও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছুটে গেছেন সেই সাথে দুস্ত ও বিপর্যস্তদের পাশে দাঁড়ায় যুবদল।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সুক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অরাজকতা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী সরকারের এহেন নৈরাজ্য, দেশ ও জনবিরোধী কার্যকালাপের বিরুদ্ধে যুবদল রাজপথে প্রতিরোধ ও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে তাদের সাথে রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষও। যারফলস্রুতিতে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে বিপুল ভোটে সর্বোচ্চ আসনে নির্বাচিত করে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন দেশের জনগণ।
আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে সাহসী ভূমিকার জন্য ২০০২ সালে যুবদলের চতুর্থ কমিটি গঠিত হলে সেখানে পূর্বের আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা রাখায় যুবদলের দায়িত্ব পান সভাপতি বরকতউল্লাহ বুলু এবং সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। বরকতউল্লাহ বুলু পূর্বে সংসদ সদস্য এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে সংসদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
পরিকল্পীতভাবে দেশের গণতন্ত্র ও বিএনপিকে ধবংস করার লক্ষে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ষড়যন্ত্রকারীদের আবির্ভাব ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে কার্যত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগ। নীল নকশার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলের পর বাকশালীয় কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানষে তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে।
জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা আওয়ামী স্বৈরশাসকের কাছ থেকে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষে আপসহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সেই লড়াই সংগ্রামকে বেগবান করতে ২০১০ সালে ১ মার্চ পঞ্চম কমিটি হয় যুবদলের। এই কমিটিতে সভাপতি হন মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপান সাইফুল আলম নীরব।
গণতন্ত্র পূণরুদ্ধারের অব্যাহত আন্দোলনকে জোরদার করতে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি যুবদলের ষষ্ঠ কমিটিতে সভাপতি হন সাইফুল আলম নীরব এবং সাধারণ সম্পাদক হন সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার ফিরেয়ে আনার রাজপথের লড়াই সংগ্রামে আহত, অঙ্গহানীসহ প্রাণ হারায় যুবদলের বহু নেতাকর্মী। সারাদেশে লাখ লাখ যুবদল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা হয়ে উঠে নিত্যদিনের বিষয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ লাখো নেতাকর্মীর ঠিকানা হয়ে উঠে আদালত ও কারাগার। যুবদল নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয় যুবদল নেতাকর্মীদের। জেল-জুলুম নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে যুবদল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের কারগার থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি ও বাংলার জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার অব্যাহত আন্দোলনে তীব্র মাত্রায় গতি পায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে। ২০২২ সালের ২৭ মে যবদলের সর্বশেষ কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে সভাপতি এবং আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে চলমান গণতন্ত্র পূণরুদ্ধারে জীবন বাজি রেখে রাজপথের লড়াই সংগ্রামে অবর্তিণ হয় যুবদলের নেতাকর্মীরা।
ঢাকাসহ দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিদ্যুতের লোডশেডিং, নিত্যপণ্য ও জ্বালানী তেলের মৃল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলার উপজেলার শহরের মহাজনপট্টিতে পুলিশের গুলিতে যুবদল নেতা আবদুর রহিত নিহত হন।
২১ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিদ্যুতের লোডশেডিং, নিত্যপণ্য ও জ্বালানী তেলের মৃল্যবৃদ্ধি এবং পুলিশের গুলিতে বিএনপি নেতাকর্মী নিহতের ঘটনায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীসহ যুবদল নেতা শাওন গুরুতর আহত হয়। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিউতে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে শাওন ইন্তেকাল করেন।
নিহত যুবদল নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি নিহত পরিবারের সদস্যদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আহত নেতাকর্মীদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছুটে গেছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ।
আওয়ামী লীগের হাত থেকে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা এবং হারিয়ে যাওয়া দেশের গণতন্ত্রপূণরুদ্ধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে লড়াই সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে নবগঠিত যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্নার নেতৃত্বে সারাদেশের যুবদলের নেতাকর্মীরা লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বন্ধী কারাগার থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করা। ৪৪ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সাংগ্রামী, গৌরবান্নিত ও ঐতিহাসিক সংগঠন যুবদলের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা ।
লেখক: যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা

 

 

 

Show More

আরো সংবাদ...

Back to top button